• সংবাদ প্রতিদিন-এর উদ্যোগ ?লিপ ডে মিল?, পাতে ভাত থাকা চাই, সাড়া দাও?
    প্রতিদিন | ০১ মার্চ ২০২৪
  • সম্বিত বসু: অপচয় সবসময়ই দিনের থেকে ট্যাক্স কেটে নেয়। সময়ের, খাবারের, নির্বুদ্ধিতার, আলস্যের– অযথা অপচয়। পৃথিবী বাঁইবাঁই করে ঘোরে, আর ঘুরতে ঘুরতে ওই অপচয়কে পুরনো চেহারায় চেনাই যায় না আর, তা হয়ে ওঠে একরকমের সহজাত অভ্যাস। রোজের সেই ক্ষয়কে বদলে দেওয়ার কথা দিব্যি ভুলে থাকা যায় তখন। এই নীল রঙের গ্রহে যে-যার বুঝে নিলেই যেন সমস্ত ঝামেলা যায় চুকেবুকে। এই ডাহা স্বার্থপরতার পরেও, কোথাও গিয়ে যেন, চোঁয়া ঢেকুর সব মনে করিয়ে দেয়– কী যেন কাজ ছিল একটা? ৩৬৫ দিনে হয়ে ওঠে না নিজের ভিতরকার সেই মেরামতির কাজ। ‘কেউ কথা রাখে না’-র দলে আমরাও দাঁড়িয়ে বেজায় ধুঁকতে থাকি। অপেক্ষা করি, একটা দিনের। সেই একদিন পৃথিবীটাকে বদলে দেওয়া যাবে।

    ক্যালেন্ডারে দেব-দেবীর বহু ছবি থাকে। কিন্তু ক্যালেন্ডার নিজেও বর দিতে পারে। এ বছর যেমন, একদিন সে এক্সট্রা দিয়েছে আমাদের। বলেছে– নাও, এবার বদলাও দেখি, যেটুকু বদল তুমি করতে চাইছ– নাও এই ২৪ ঘণ্টা, অপচয়ের অ্যাকাউন্টে জমা কোরো না এই সময়। ক্যালেন্ডারের এই ম্যাজিক টের পেয়েছে ‘সংবাদ প্রতিদিন’। তাই নেওয়া হয়েছিল লিপ ডে মিল পৌঁছনোর উদ্যোগ। এই প্রয়াসে পাশে ছিল ‘খোসলা ইলেকট্রনিক্স’, ‘চাউম্যান’ এবং ‘আর্সালান’।

    কলকাতা জুড়ে (উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য) আমরা কিছু মানুষের ঠোঁটে একবেলার জন্য অপূর্ব এক হাসি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি। না, স্ট্যান্ড আপ কমেডি দিয়ে নয়, কাতুকুতু দিয়ে নয়, লাফিং গ্যাস ছড়িয়ে নয়, আমাদের হাতে ছিল খাবারের প্যাকেট। তা যখন বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছিল কলকাতার রাস্তায়, সে অরবিন্দ সেতু এলাকা হোক, শিয়ালদহের কোলে মার্কেট হোক, কালীঘাট কিংবা খিদিরপুরে হোক– আমরা টের পেয়েছিলাম মানুষের খিদে। টের পেয়েছিলাম নিরন্নের দীর্ঘ লাইন, যা এই কলকাতা কেন, এই পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই যেন না পড়ে। সেই লাইন, ক্রমে ভেঙে যায়, ছত্রাকার হয়ে যায় কখনও-সখনও, জমাট খিদের হাতে উঠতে থাকে মাত্র একবেলার খাবার। বিনিময়ে আমরা দেখি অপূর্ব হাসির সমুদ্দুর। ইশকুল-বালকের হাতে জুড়ে দিই টিফিনবক্স। যে ছিল ছেঁড়া স্যান্ডোয়, তার কাঁপা হাতে খাবার দিতে দিতে মনে মনে উচ্চারণ করি, রোজ যেন জুটে যায় কিছু। যার হাত থেকে পড়ে ছড়িয়ে গেল খাবার, তাকেও অনিশ্চিত খিদের দিকে ফিরিয়ে দিই না। অসংখ্য মায়ের চোখে-মুখ চিকচিক করে ওঠে এই আকস্মিকের খেলায়।

    ‘কেউ যদি বেশি খাও/ খাবার হিসেব নাও/ কেননা অনেক লোক ভালো করে খায় না’,– সেই কবে লিখেছিলেন কবীর সুমন। খাবার হিসেব নিতে শুরু করলে, আমরা এখনও দেখব, রোজের অপচয়ে ভরে উঠছে পাড়ার ডাস্টবিন। উপচে পড়ছে আমাদের অনর্থক অর্থ দিয়ে কেনা খাবারের মালিকানা। তা কখনও ডাইনিং টেবিলে পাহারা দিচ্ছে মাছির দল, কখনও ফ্রিজের মধ্যে কঠিন হচ্ছে এক্সপায়ারি ডেটের পাউরুটি। কখনও বা অতিথি আপ্যায়নের বশে ফুড ডেলিভারি সংস্থার থেকে বিপুল পরিমাণ খাবার এনে পড়েই থাকছে অশেষ অবহেলায়। এত অপচয়ের পরও আমরা ক্লান্ত হই না। কারণ আমরা চারপাশে আর তাকাই না তেমন করে। আমরা চিনতে পারি না যথাযথ খিদে। শুধু নানা ছলে, অর্থের আনুকূল্যে চেয়ে যাই। খাবার আসে, পেট ভরে, প্লেট তবু শূন্য হয় না।

    এই উদ্যোগ নিয়ে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর প্রধান সম্পাদক সৃঞ্জয় বোস বলেন, “উদ্যোগ যদি শেষমেশ ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এরই বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ বলে পরিচিত হয়, তাহলে তা অসফল। মানুষকে যদি ভাবাতে পারা যায় দৈনিক অপচয়ের কথা, তাহলেই উদ্যোগটি সাফল্য পাবে। উপকারের আসলে কোনও কপিরাইট নেই।’ তাঁর কথাতেই পরিষ্কার, এই ২৯ ফেব্রুয়ারি এক্সট্রা দিন, আসলে আমাদের সম্মিলিত হওয়ার শিক্ষা। এই একদিন যদি ছড়িয়ে যায় রোজের ভাবনায়, তবেই কিছু হল, নতুবা নয়।

    খোসলা ইলেক্ট্রনিক্স-এর সহ-কর্ণধার মনোজ খোসলা বলে দেন, ?এক্সস্ট্রা দিনে এক্সট্রা খাবার দেওয়ার উদ্যোগ সংবাদ প্রতিদিন-এর। আমি খুব আনন্দিত এরকম একটা কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পেরে। এই সমাজের জন্য সকলেরই কিছু কর্তব্য আছে, দশে মিলে সেই কাজটাই আমাদের প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে।? চাউম্যান-এর প্রতিনিধি সোহিনী জানান, ?বাড়তি খাবারে যদি মানুষের মুখে বাড়তি হাসি ফোটে তার থেকে আনন্দের আর কিছু হয় না। বছরের বাড়তি দিনে সংবাদ প্রতিদিন-এই প্রয়াস গোটা সমাজকেই বার্তা দেবে। এরকম প্রয়াসে শামিল হওয়া আনন্দের, গর্বেরও। সকলেই এরকম প্রয়াস নিন।?

    ‘ফিড’ সংস্থার কর্ণধার চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর সঙ্গেও এ ব্যাপারে কথা হয়। তিনি জানান, “আট বছর ধরে উদ্বৃত্ত খাবার নিয়ে কাজ করছি। অপচয় যে খুব কমাতে পেরেছি, বলব না। তবে একটা সচেতনতা তৈরি করা গিয়েছে। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর মতো সংস্থা এগিয়ে আসায় আমি খুব খুশি। সচেতনতা নিঃসন্দেহে বাড়বে। অনুষ্ঠান বাড়িতে খাবার নষ্ট বন্ধ হোক। আমাদের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই নিয়ে লাগাতার প্রচারে নামছে। ‘সংবাদ প্রতিদিন’ সঙ্গী হলে প্রচারের পরিধি বাড়বে।’

    ২৯ ফেব্রুয়ারি, সকাল ১১-৫টা– রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছে সংবাদ প্রতিদিনের কর্মীরা, সঙ্গে খাবারের প্যাকেট। এই উদ্যোগ কোনওভাবেই সফল হত না ‘খোসলা ইলেকট্রনিক্স’, ‘চাউম্যান’, ‘আর্সালান’ পাশে এসে না দাঁড়ালে। যদিও আমরা জানি, টের পেয়েছি ভালোমতোই, এ কোনও একদিনের কাজ নয়। তবু, এই একদিন দিনগত পাপক্ষয়ের থেকে খানিক আলাদা।

    ফেব্রুয়ারি ২৯, তুমি ছদ্মবেশে এসো রোজ।
  • Link to this news (প্রতিদিন)