মহিলা ভোটারদের আস্থা পেতে এবার রামমোহনেই শরণ মোদীর
এই সময় | ০১ মার্চ ২০২৪
রাম নামে অভ্যস্ত নরেন্দ্র মোদীর মুখে রামমোহনের নাম! তাই নিয়ে মস্ত কৌতূহল তৈরি হয়েছে সাধারণের মনে। শুক্রবার আরামবাগে দলের প্রচার সভা থেকে 'ভারতপথিক' রাজা রামমোহন রায়ের নাম মোদী উচ্চারণ করেছেন যদিও সন্দেশখালির প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে। তবে তাঁর এই উচ্চারণ বহুমাত্রিক। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বুঝে নেওয়া যাক, নরেন্দ্র মোদী ঠিক কী বলেছেন। সন্দেশখালি প্রসঙ্গে এদিন মোদী বলেন, 'সন্দেশখালির মহিলাদের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা দেখে গোটা দেশ ক্ষুব্ধ। আমি বলতে পারি যে রামমোহন রায়ের আত্মা যেখানেই থাকুক না কেন, এই লোকেদের এই কাজ দেখে অত্যন্ত বেদনা পাবেন। সন্দেশখালিতে তৃণমূল যা করেছে, তাতে রামমোহন রায়ের আত্মা কাঁদবে। তৃণমূল নেতারা সন্দেশখালির মহিলাদের সঙ্গে যা করেছে, তাতে দুঃসাহসের সব সীমা পার হয়ে গিয়েছে। সন্দেশখালির মহিলারা মুখ খুলেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্য চেয়েছেন। বদলে কী পেয়েছেন? বিজেপি নেতারা মা-বোনেদের জন্য দিন-রাত লড়েছেন। মার খেয়েছেন। বিজেপি নেতাদের চাপে পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছে।'
এদিন মোদী তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেন, 'মাতৃশক্তির কথা বলব। কিছুটা দূরেই খানাকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। যিনি নারীশক্তিকে তুলে ধরেছিলেন।' হ্যাঁ, মোদী যেখানে বক্তব্য রাখছিলেন, সেখান থেকে ২০-২২ কিলোমিটার দূরে ১৭৭২ সালে খানাকুলের রাধানগরে জন্মেছিলেন রামমোহন রায়। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মানো এই মানুষটি ছিলেন সর্বার্থেই ব্যতিক্রমী। পরিবার ও চলতি সামাজিক প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি মূর্তি পূজার বিরোধিতা করে বই লেখেন। নিরাকার ঈশ্বরের সাধনা করতে ব্রাহ্ম ধর্ম স্থাপন করেন। কিন্তু এর জন্য তিনি যতই খ্যাত হন, রামমোহন রায় বাঙালি তথা ভারতের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য। এমনকী, বাল্যবিবাহ রোধের জন্যও তিনি উদ্যোগী হন। এসব সমাজ সংস্কারের কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রবল বাধার মুখে পড়েছিলেন। তাঁর মা পর্যন্ত তাঁকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। কিন্তু এই বিরাট হৃদয়ের মানুষটি তাতেও দমেননি। এমনকী, রাধানগরে শ্মশানে নিজে বাড়ি তৈরি করেছিলেন বসত করবেন বলে।
আরামবাগের সভা থেকে হুঁশিয়ারি মোদীরসেই রামমোহনের প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলকে বেঁধার মোদীয় কারণটি স্পষ্ট। মোদী-শাহ সহ গোটা বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সাফল্যের জাদুকাঠি মেয়েদের বিপুল সমর্থন। তাই সন্দেশখালির ঘটনা, যেখানে তৃণমূলের নেতাদের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রথম সারিতে আছেন মহিলারা, সেই নারীসমাজের পরম পরিত্রাতা হিসেবে রামমোহনকে টেনে এনেছেন মোদী। এভাবেই তিনি জোর ধাক্কা দিতে চেয়েছেন মমতাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে মোদী মমতাকে 'দিদি, দিদি' বলে তির্যক স্বরে ডেকে দলের বিপদ ডেকে এনেছিলেন। বাংলার মানুষ, বাংলার মেয়েকে এভাবে 'টিপ্পনী' মেনে নিতে পারেননি। ভোটে তার প্রতিদান তাঁরা দিয়েছিলেন।
ভোটকুশলীরাও মনে করেন মমতার 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার', 'কন্যাশ্রী', 'রূপশ্রী', 'স্বাস্থ্যসাথী'র মতো প্রকল্পগুলি বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে যে মমতাই একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যিনি মেয়েদের কথা আলাদা করে চিন্তা করেন। সেই বিশ্বাসের মূল কথা অনেকটা এরকম, 'তিনি আমাদের লোক'। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্যের দুটি স্তম্ভ - ১) সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক, ২) মহিলা ভোটব্যাঙ্ক। মোদী জানেন, রামমন্দির, জ্ঞানবাপী নিয়ে যে যে পদক্ষেপ তাঁর সরকার করেছে, তারপর সংখ্যালঘুদের মন জয় করা পদ্মশিবিরের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব, লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে এসে নিশানা করা যাক তৃণমূলের মহিলা ভোটব্যাঙ্ক। মমতার এই মহিলা ভোটব্যাঙ্কে ধস নামাতেই আরামবাগ থেকে রাম ছেড়ে 'রাজা রামমহোহন রায়'-এ শরণ নিতে হল নরেন্দ্র মোদীকে।