কুণাল বসু১৯৪৮ সালে অঙ্কবিদ নরবার্ট ওয়াইনার-এর ‘সাইবার-নেটিক্স: অর কন্ট্রোল অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইন দ্য অ্যানিম্যাল অ্যান্ড দ্য মেশিন’ পড়ার পরে নড়েচড়ে বসেন অনেকে। বিশেষত গণিতবিদ, পরিসংখ্যানবিদ ও যাঁরা সিস্টেমস নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা। বোঝা যায়, সাইবারনেটিক্স অনেক কিছুর মিশ্রণ। আদতে সিস্টেমস থিয়োরির ফিডব্যাক ও কমিউনিকেশন সংক্রান্ত বিজ্ঞান, মিশেছে অঙ্ক, কন্ট্রোল সিস্টেমস, বায়োলজি, সাইকোলজি ও সোশ্যাল সিস্টেমস।
এই চিন্তা ওয়াইনারের মাথায় আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। যখন তিনি ইউএস নেভিকে সাহায্য করেন অ্যান্টিএয়ারক্র্যাফট গানকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে লক্ষ্যে স্থির করে গুলি চালাতে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সিস্টেমস কন্ট্রোলের থিয়োরি হাজির করেন সাইবারনেটিক্স নিয়ে বইয়ে।
ভারতীয় গণিতবিদ, পরিসংখ্যানবিদদের মধ্যে এর প্রভাব এতই ছিল যে, তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৫-এ সাত মাস তিনি কাটান আইএসআই-তে। আমন্ত্রণ জানান প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। তখন ষাটটি লেকচার দেন ওয়াইনার। দ্রুত প্রভাবিত হতে থাকেন দিল্লি ইউনিভার্সিটি ও সিএসআইআর-এর বিজ্ঞানীরা।
ছয়ের দশকে সিএসআইআর ভাবতে শুরু করে অর্থনৈতিক প্ল্যানিং ও ডেভেলপমেন্টের কাজে সাইবারনেটিক্স নিয়ে। পুরোধা অমিতাভ ঘোষাল। প্রভাব পড়ে সফ্টওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে— টাটা কনসাল্টিং সার্ভিসেজ়ে। টিসিএস হায়দরাবাদে সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সাইবারনেটিক্স সেন্টার তৈরি হয় পিএন মূর্তি-র নেতৃত্বে। সাহায্য করেন ওয়াইনারের ছাত্র এফসি কোহলি।
১৯৪৮ সালে প্রথম বইয়ের দু’বছর পরে ওয়াইনার আর একটি বই লেখেন: ‘দ্য হিউম্যান ইউজ় অফ হিউম্যান বিইংস’। প্রশ্ন তোলেম সমাজে মানুষের উপর সাইবারনেটিক্সের কন্ট্রোল নিয়ে। কিন্তু তত ক্ষণে তির বেরিয়ে গিয়েছিল ধনুক থেকে। ওয়াইনারের মন্ত্রে প্রভাবিত হয়ে চিন শুরু করেছে ওয়ান-চাইল্ড পলিসি। চিনা মিসাইল প্রোগ্রামের জনক কিয়ান জ়িউসেন আগ্রহী হন ওয়াইনারের কাজে।
চিন সাইবারনেটিক্স কাজে লাগিয়ে গণনা করে, তাদের দেশে আদর্শ জনসংখ্যা। চালু হয় ওয়ান-চাইল্ড পলিসি। ফলে চিনের গ্রামাঞ্চলে সমস্যা, একের বেশি সন্তান যাঁদের তাঁরা সরকারি খাতায় রেজিস্টার করাতে পারেননি দ্বিতীয়-তৃতীয় সন্তানকে। জন্ম হয় ‘ব্ল্যাক চিলড্রেন’-এর, যারা স্কুল বা স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত।
আমেরিকায় এই ধারণার জন্ম বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন শুরুতে নাক সিঁটকেছিল সাইবারনেটিক্স নিয়ে। কিন্তু স্তালিনের মৃত্যুর পরে তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়। আদতে তো জনগণের উপর সারভাইল্যান্স ও কন্ট্রোল। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় এস্তোনিয়া। ছয়ের দশকে ইনস্টিটিউট অফ সাইবারনেটিক্স তৈরি হয় এস্তোনিয়ায়। সাইবারনেটিক্সে শিক্ষা পেতে থাকে দেশের বড় অংশ। ইনস্টিটিউটে এক সময়ে ছিলেন, এ রকম কয়েকজন মিলে ১৯৯৭ সালে তৈরি করেন সংস্থা: সাইবারনেটিকা।
তাঁদের কাজ ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমস তৈরি করা, মেরিটাইম কমিউনিকেশন্স তৈরি করা ও সারভাইল্যান্সের ব্যবস্থা। সঙ্গে ক্রিপ্টোগ্রাফির গবেষণা। শেষ পর্যন্ত এই সংস্থা ডিজিট্যাল আইডেন্টিটি, ডিজিট্যাল সিগনেচারের টেকনোলজি তৈরি করে। দেশের নাগরিককে ই-গভর্নেন্স সুবিধা দেওয়ার ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি হয় এখানেই। এস্তোনিয়াকে এ জন্য অনেকে ডিজিট্যাল রিপাবলিক বলতে শুরু করেছিলেন।
ভারতে সেই ঢেউ এসে পড়ে নতুন শতকের প্রথম দশকে। চিন্তাভাবনা শুরু হয়। আধার কার্ড তৈরি হয় মূলত তার পরের দশকে। এবং, ধীরে ধীরে সরকারি নানা কাজেই কম্পালসরি হয়ে ওঠে আধার। কিন্তু এটা কি সত্যিই আইডেন্টিটি? অ্যাড্রেস প্রুফ? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তা নয়। সেই সঙ্গে আধার ডেটাবেস থেকে বায়োমেট্রিক চুরির ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে। সারভাইল্যান্সের প্রশ্ন তো আছেই। তবে আধারের ভবিষ্যৎ কী? এই প্রশ্নে এসেই পুরো ব্যাপারটা কী রকম যেন অস্বচ্ছ হয়ে যায়।