রূপসা রায়ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন কি তবে সত্যিই বদল আনতে পারল সমাজে? কারণ ফেয়ারনেস ক্রিমের কেনাকাটা খানিকটা পড়তির দিকে ২০২৩ সালে। নগণ্য হলেও ৩ শতাংশ কমতি, কম নয়। কাস্টমারদের প্রেফারেন্স এখন ত্বকের উজ্জ্বলতা, ডালনেস কমানোর মতো বিষয়, ত্বক যাতে আর্দ্র থাকে, তার সুলুকসন্ধান। কিন্তু কালো ত্বককে ফর্সা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পণ্যের বিক্রি কমের দিকে।
সমীক্ষাটি করেছে নিয়েলসেন আইকিউ। তাদের দাবি, এই প্রথম ফেয়ারনেস ক্রিমের চাহিদা সামান্য হলেও কমেছে। এবং এই কমার পিছনে রয়েছে জেন জ়েড। অর্থাৎ, এখনকার তরুণ প্রজন্ম আর ফর্সা হতে ছুটছে না। বরং যে রঙের ত্বক সে জন্মগত ভাবে পেয়েছে, তা নিয়ে খুশি। আর সেই ত্বকের যত্ন নিতেই সে সন্ধান চালাচ্ছে বিউটি প্রোডাক্টের, ত্বকের রঙের খোলনলচে বদলে ফেলতে নয়।
ইউরোপ আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষ যে ভাবে রয়েছে, তা হয়তো ভারতীয় উপমহাদেশে একই ভাবে নেই। কিন্তু অন্য ভাবে আছে। কারণ, ভারতের বেশির ভাগ মানুষই কালো। ঠিক কালো নয়, বাদামি। তবে ফর্সা নয়। কিন্তু উপনিবেশের প্রভুরা আমাদের শিখিয়েছিল, সাদা মানেই ভদ্র, সভ্য ও ক্ষমতা। যারা কালো, তারা ঠিক ভদ্র, সভ্য নয়, ক্ষমতাহীনও খানিক।
ফলত, ভারতীয়রা ওই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেরা সাদা না হলেও তার চেয়ে বেশি কালোকে দূরছাই করে, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান কারওকে দেখলে বলে ওঠে ‘কেলে মানিক’, কালো বলে বহু নারীর ‘বিয়ে হয় না’, কারণ পাত্রপক্ষের নজর ফর্সা পাত্রীর দিকে। আবার ও দিকে, কালো নিয়ে সমাজে নানা ট্যাবু, না-চাওয়া থাকায় সেই ব্যাপারটাকে খানিকটা সামাল দিতে রয়েছে কালোর উচ্চকিত প্রশংসা।
যেমন ‘কালো জগতের আলো’, ‘কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ’, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে’… যেন বা কালো আসলে কালো নয়, তার মধ্যেই আলোর রহস্য! মানে কালো ফর্সারও উপরে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, কালো আসলে ভালো-খারাপ কিছুই নয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলির মানুষের ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ বেশি হয়, ফলে ত্বক কালোর দিকে হয়। এই কারণগুলি এখন সকলের জানা।
কিন্তু তার পরেও চেষ্টা চলে কালোকে সাদায় পরিণত করার। কারণ ওই যে, সাদা মানেই ‘সুন্দর’ আর কালো মানে ‘অসুন্দর’— মাথায় গেঁথে আছে যে! নতুন প্রজন্মের হয়তো এই স্টিরিওটাইপ থেকে বেরোচ্ছে, অপমানটা আর নিজেদের করতে চাইছে না। ফলে ফেয়ারনেস ক্রিম কেনায় ঘাটতি!
কিন্তু এই প্রসঙ্গে অন্য একটা বিষয়ও ভাবার আছে। জন্মগত ভাবে পাওয়া গায়ের রং বদলিয়ে অন্য রকম, বিশেষ করে সাদা হওয়ার এমন বাসনা তৈরি হয়েছিল কী ভাবে? এখনও খানিক কমলেও তো এই বাসনারই আধিপত্য। এখানেই আসে আসল প্রশ্ন, আমরা যা নিজেদের ‘ইচ্ছা’, ‘বাসনা’ বলে ভাবি, তা কি আদৌ আমাদের? ‘বাসনা’, ‘ইচ্ছা’র উৎস কি অস্তিত্বগত ভাবেই সমাজহীন, ইতিহাসহীন? নাকি, আসলে বাসনা তৈরি করা হয়? যাকে বলা যেতে পারে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ডিজ়ায়ার’। কী ভাবে তৈরি করা হয় সেই ডিজ়ায়ার? বাজার তৈরি করে।
এই যে প্রায় কোনও কালেই কালো না ফর্সা, তা দিয়ে অন্তত ভারতীয় পুরুষদের কিচ্ছুটি যায় আসত না, কারণ সকলেই ভাবত ‘সোনার আংটি সোজা না ব্যাঁকা, তা বিচার করে কী হবে’, সেই পুরুষদের জন্যও কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে বাজারে এসেছিল ফেয়ারনেস ক্রিম। বহু দশক ধরে ভারতীয় মেয়েদের লক্ষ্য করে বানানো একটি প্রোডাক্ট, পরবর্তী ধাপে পুরুষদের জন্যও বিশেষ ভাবে বানানো হতে লাগল। সেটা চললও তো বেশ কিছু দিন। পুরুষদের মধ্যে ফর্সা হওয়ার ইচ্ছা তৈরি করল কে? সেও তো বাজার-ই!
কিন্তু ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পরে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াজুড়ে, তার প্রভাব থেকে বাদ গেল না ফেয়ারনেস বিউটি প্রোডাক্ট বানানো সংস্থাগুলিও। কারণ প্রশ্নটা মৌলিক, মানুষের কোন ‘দুর্বলতা’কে ভিত্তি করে বাড়ছে তাদের লাভ? কোন অধিকারে তারা বলেন, ‘কালো হলে আত্মবিশ্বাসের অভাব হবে?’ এই এথিক্যাল প্রশ্নগুলি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে উঠতেই তারা রীতিমতো ভয় পেয়ে বন্ধ করে দিল তাদের স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টগুলিতে ‘ফেয়ার’, ‘হোয়াইট’, ‘লাইট’ শব্দগুলির ব্যবহার।
বাধ্য হল, বাসনা ম্যানুফ্যাকচারিং-এর মোডটিকে বদলাতে। হয়তো তাঁরা বিক্রি করছেন একই জিনিস, কিন্তু নীতিগত প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ভয়ে ব্যবহারিক দায়ে শব্দগুলো নিল তুলে। ও দিকে, সদ্য তরুণ প্রজন্ম, যাদের হাতের মুঠোয় দুনিয়া ইন্টারনেটের সৌজন্যে, তাদেরও কি প্রভাবিত করেনি ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা জায়গায় কৃষ্ণাঙ্গদের উপর অত্যাচার ও পাল্টা আন্দোলনের কাহিনি?
নাকি, ভারতের নারীরা (যেহেতু এই ধরনের প্রোডাক্টের বেশির ভাগ ক্রেতাই নারী) যেহেতু ক্রমে সামাজিক শ্রমে যুক্ত হচ্ছেন, স্বনির্ভরতা খানিক হলেও বাড়ছে, তারা আর বিয়েটাকেই একমাত্র পরিণতি হিসেবে ভাবছেন না? ফলে ফর্সা হতে আকুলও নন আর? বরং, আত্মসম্মানের সঙ্গে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে, তাদের বাসনা তৈরি হচ্ছে অন্য রকম, সেটা আর যাই হোক, ফর্সা হওয়া নয়। আর সে জন্যই ফর্সা মেয়ে খোঁজা মানুষের বাসনা চরিতার্থ করতে তাদের মাথাব্যথা নেই! হতেই তো পারে!