বিশ্বাসে মিলায় হার্বাল, অ্যালোপ্যাথে বহু দূর, বিজ্ঞান কী বলে
এই সময় | ০৩ মার্চ ২০২৪
বিষাণ বসুগত শতাব্দীর শেষের দিক। আমরা তখন ছাত্র। লাইব্রেরিতে কিছু বিদেশি জার্নাল আসত। এক অগ্রজপ্রতিম তরুণ স্যারের সঙ্গে আমরা কয়েকজন যেতাম, গিয়ে জার্নাল পড়তাম। সেখানেই জেনেছিলাম, প্রথম বিশ্বের বেশ কিছু দেশে ‘হেভি মেটাল পয়জনিং’— শরীরের ভেতরে বিভিন্ন অঙ্গে সোনা সীসা পারদ জাতীয় ভারী ধাতুর জমা হওয়া— উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে।
কারণ হিসেবে তাঁরা চিহ্নিত করেছিলেন ওষুধের দোকানে আলটপকা বিক্রি হওয়া কিছু ‘হার্বাল মেডিসিন’-কে। উন্নত বিশ্বে ওষুধ বিক্রির ব্যাপারে বেশ কড়াকড়ি আছে, চাইলেই দোকানে গিয়ে যা খুশি ওষুধ কিনে ফেলা যায় না। কিন্তু ‘হার্বাল মেডিসিন’-এর সমস্যা হল, এগুলো সাধারণত তালিকাভুক্ত ওষুধের মতো করে বিক্রি হয় না, আর পাঁচটা ওষুধের মতো এগুলোর গুণগত মানের পরীক্ষানিরীক্ষার বন্দোবস্ত (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) নেই, এবং যে কেউ এ সব ওষুধ ‘স্বাস্থ্যরক্ষা’-র জন্য কিনে খেতে পারেন।
পড়ে অবাক হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, বিলেতেই যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে এ দেশে? গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশক অবধি, হিমালয়ের কোলে এক চিকিৎসা-আশ্রমে জনৈক সন্ন্যাসী-চিকিৎসক (রামদেব নন) মৃগী রোগের ‘অব্যর্থ ঔষধ’ বিক্রি করতেন। এই রাজ্যের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায় তার বিজ্ঞাপন বেরোত। তিনি নাকি প্রথম ডোজটি রোগীকে স্বহস্তে খাইয়ে দেন, তার পর মাসছয়েকের ওষুধ রোগীর হাতে দিয়ে বাড়ি পাঠান।
এর কিছু দিনের মধ্যেই আফিম-জাতীয় ওষুধের বেআইনি ব্যবসার অভিযোগে সে চিকিৎসা-আশ্রম বন্ধ হয়ে যায়, সন্ন্যাসী-চিকিৎসকের কী সাজা হয়েছিল, তা আর মনে নেই। কিন্তু এই ঘটনার পরোক্ষ অভিঘাত টের পেয়েছিলেন কলকাতার স্নায়ুরোগ-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। মৃগী রোগে ভুগতে থাকা অজস্র মানুষ আচমকা তাঁদের কাছে উপস্থিত হতে থাকলেন, যাঁদের অসুখ বাজারচলতি কোনও ওষুধেই সারে না।
বলা বাহুল্য, এঁরা সকলেই এত দিন ধরে উপর্যুক্ত আশ্রমের ওষুধ খেতেন। জনৈক দুঃসাহসী চিকিৎসক এক রোগীর সংগ্রহে থাকা কিছু ভেষজ বড়ি কলকাতার একটি বিশিষ্ট ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। মৃগী রোগের সব ওষুধের রাসায়নিক নির্ণয় সেখানে হত না, তবে যে পাঁচখানা ওষুধের পরীক্ষা হত, তার সব ক’টিই সেই বড়িতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া গিয়েছিল।
আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানে দীক্ষিত চিকিৎসকরা অমন করে একই সঙ্গে চার-পাঁচখানা ওষুধ দিতে পারেন না, তা হলে পাঁচ রকম দাবাইয়ে অভ্যস্ত মৃগী রোগ তাঁরা সারাতে পারবেন কোত্থেকে? ঘটনাটি কোনও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। সেই চিকিৎসকই জানাজানি করতে ভয় পেয়েছিলেন। আমি জেনেছি স্রেফ ব্যক্তিগত সূত্রে।
অতএব, বাবা রামদেব ও পতঞ্জলির উত্থানের বহু আগে থেকেই, এ দেশে এবং বিদেশেও, আয়ুর্বেদিক ঔষধ তথা হার্বাল মেডিসিন একটি অনিয়ন্ত্রিত শিল্প। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে— এবং প্রথাগত বিজ্ঞানশিক্ষার পরিমাণ নির্বিশেষেও— এ দেশে তো বটেই, উন্নত দেশেও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার খুব একটা ঘটেনি। এর কারণ বহুবিধ। বিজ্ঞানজগতের লোকজন বিজ্ঞান বিষয়ে সাধারণের বোধগম্য ভাষায় বলেন বা লেখেন না, ও-দিকে বিজ্ঞানের খবর হিসেবে মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয় তার অধিকাংশই অর্ধেক বুঝে লিখে ফেলা হাইপ বা গিমিক।
বিজ্ঞান বিষয়ে আস্থা যেটুকু, তার মধ্যেও বিশ্বাস ও ভক্তিরই প্রাধান্য, বিজ্ঞানবোধ বা বিজ্ঞানমনস্কতা অনুপস্থিত। তদুপরি বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের রমরমা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে তার কদর্য প্রকাশ দেখে এমনকি বিজ্ঞানজগতের মানুষের মনেও সন্দেহ জাগতে বাধ্য। এরই বিপরীতে, যা কিছু প্রাকৃতিক, তা-ই সহজ ও স্বাভাবিক, সুতরাং ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে মুক্ত, শরীরের পক্ষে উপকারী, এমন বিশ্বাস। তা হলে যে সাপের বিষ বা বটুলিনিয়াম টক্সিন, দুই-ই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, অথচ প্রাণঘাতী, এ কেমন বিচার— এই সহজ প্রশ্ন কারও মনে জাগে না।
এক দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উত্তরোত্তর জটিল হওয়া, ক্রমশ দুর্মূল্য হয়ে ওঠা —তদুপরি তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ক্ষতিকারক প্রভাব বিষয়ে উৎকণ্ঠা— আর একদিকে ‘ন্যাচারাল হিলিং’ বিষয়ে বাড়াবাড়ি আস্থা, গ্রিন টি-র উপকারিতা বিষয়ে অত্যধিক প্রত্যাশা বা গ্রিন কফি খেয়ে রোগা হওয়ার আশা দিয়ে যার শুরু, পতঞ্জলি-র ক্যাপসুল খেয়ে নীরোগ থাকার আকাঙ্ক্ষা তার থেকে দূরে নয়। মিডিয়ায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের প্রভাবও অনস্বীকার্য— সব মিলিয়ে এ দেশে (এবং বিদেশেও) ‘প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সারিয়ে তোলার’ আশ্বাসযুক্ত আয়ুর্বেদের প্রসার ক্রমবর্ধমান।
এতে প্রচারের আলো আছে, জটিল আর্থসামাজিক বাস্তবতা, রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা আছে, বিজ্ঞান নেই। বিভিন্ন মনগড়া দাবি ও সরকারি হিন্দুত্ববাদের বয়ানের সঙ্গে আয়ুর্বেদের প্রচার মিলিয়ে আয়ুর্বেদ শিল্পের উন্নতি ঘটছে বটে, কিন্তু চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে আয়ুর্বেদের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল তা ক্রমশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চলেছে, নিশ্চিত। বিলেতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে শল্যচিকিৎসার আদিপুরুষ হিসেবে সুশ্রুত-এর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে, সে খবরে আমাদের বংশগৌরব বাড়লেও বাড়তে পারে, কিন্তু হাজার ঢক্কানিনাদ সহযোগে সুশ্রুতসংহিতার হুবহু অনুসরণের কথা বললে যে দেশের শল্যচিকিৎসা এতটুকুও এগোবে না— এ নিয়ে সংশয় নেই।
অথচ, দেশের সুপ্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতির সুফল কী ভাবে সমকালে পৌঁছে দেওয়া যায় এবং সেই সুবাদে দেশের চিকিৎসা-ঐতিহ্যকে কীভাবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, তার চমৎকার নজির হাতের কাছেই ছিল— চিনের গবেষক তু ইউইউ যে ভাবে হাজার বছরের পুরনো পুঁথি ঘেটে ম্যালেরিয়ার ওষুধ আর্টেমিসিনিন পুনরাবিষ্কার করলেন এবং সেই ওষুধকে সমকালীন বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করে যাচাই করে প্রয়োগ করে সাফল্যলাভ করলেন— আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম এবং নোবেল পুরস্কার দ্বারাও স্বীকৃত।
তা আমাদের মডেল হতে পারত। হল না, কারণ এ দেশে আয়ুর্বেদের প্রসার ঘটানোর প্রয়াস উপলক্ষ মাত্র, মুখ্য অভীষ্ট সুপ্রাচীন অতীতের রেফারেন্স দিয়ে সনাতন ধর্মের কথাটি বারবার মনে করিয়ে দেওয়া। অতএব, সংস্থা কী গবেষণা করছে, সে গবেষণালব্ধ কার্যকারিতার প্রমাণ আদৌ কোনও স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে কি না, এই সবই গৌণ। মুখ্য হল, সংস্থার মালিক গেরুয়া-পরিহিত বাবাজি, তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য ও দেশের শাসক দলের অনুগামী। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় অর্থের জোগান ক্রমহ্রাসমান হলেও সংস্থা জলের দরে (বা বিনেপয়সায়) জমি পায়, বিপুল সরকারি আনুকূল্য লাভ করে।
আজ সর্বোচ্চ আদালত পতঞ্জলির অনিয়ম নিয়ে বলেছেন, পতঞ্জলি তাদের পণ্যগুলিকে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ওষুধ হিসেবে বিজ্ঞাপিত করতে পারবে না, আগের নির্দেশ মানেনি বলে আপাতত কোনও বিজ্ঞাপনই দিতে পারবে না এবং আদালত অবমাননার নোটিশের উত্তর দু’ সপ্তাহের মধ্যে দিতে বলেছেন। যদিও পতঞ্জলির দাবি, শীর্ষ আদালতের এই রায় তাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে না। দেখা যাক, কী হয়।
অথচ করোনাকালে স্বয়ং সরকারই ‘করোনিল’-কে করোনার অব্যর্থ দাওয়াই হিসেবে জানিয়েছিলেন! এ ব্যাপারে পতঞ্জলি কি একা? আরও কত সংস্থা কত জড়িবুটিকে কত রোগের ওষুধ হিসেবে প্রচার করে চলেছে, সরকারি অর্থে আয়োজিত মেলায় সে সব ওষুধের বিক্রিও রমরমিয়ে চসছে, তার বেলা? তবে কি বিজ্ঞাপনের লব্জ ধার করে বলতে হয়, রামদেব রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র।