কেঁদে, কাতুকুতু খেয়ে অবাক পৃথিবীকে নিউ নর্মাল বানান!
এই সময় | ০৩ মার্চ ২০২৪
সৌমিত দেবযুবক-যুবতী, যুগলে হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। উল্টো দিক থেকে এগিয়ে এসেছে আর একটি যুবক। ধাক্কা লাগল দুই যুবকের। যুগল যুবক ধাক্কা যুবককে মারতে গিয়ে দেখল ধাক্কা যুবকের গলায় একটা লকেট ঝুলছে। তাতে মা’ লেখা৷ এই দেখে যুগল যুবক ধাক্কা যুবকের হাতটা তুলে নিয়ে, নিজের গালে একটা চড় মেরে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল স্লো-মোশনে৷ ধাক্কা যুবক অবাক। যুবতী অবাক।
অডিয়েন্সও অবাক… হ’ত। তবে একেবারে প্রথম দিকে। টিকটক নবজাগরণের সময়ের সেই সব ঐতিহাসিক সোনালি দিন।
মানুষ তখন বুঝতে পারছে না, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, যেমন মানুষ গ্যালিলিওকেও বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু প্রতিভার বিচ্ছুরণ থামানো যায় না ইন্টেলেকচুয়াল ফতোয়া জারি করে। তাই নানা মনীষীর প্রতিভার আলোয় আলোকিত যে উদ্ভটরস চলকে পড়েছিল সকলের মননে, সেই একই ধারা আজও চলছে, চলেছে। কারণ অনেক গম্ভীরগোমড়াসিরিয়াসবাদীরা যা পারেনি, এই মহাপুরুষরা তা পেরেছেন।
বহুদিন ধরে চলে আসা ‘ছেলেরা কাঁদে না’ ধর্মী ন্যক্কারজনক পুরুষতান্ত্রিক মন্তব্য ও ধারণা গুঁড়িয়ে পিষে একাকার হয়েছে যখন এক পুরুষ শিল্পী শুধু কেঁদে বিখ্যাত হয়েছেন। আর সে কান্না, যে-সে কান্না নয়। একেবারে ডাক ছেড়ে, বগল তুলে, বুক চাপড়ে, নিজের সারা গায়ে জল ছিটিয়ে, গাধা গার্গল করলে যেমন শব্দ হতে পারে সেই একই নাদে, ত্রাহি ত্রাহি কান্না। তার পর ঠিক সেটাই হল, যেটা সব সময় হয়।
উত্তমকে নকল করতে শুরু করল বাকিরা। চারপাশে সমস্ত কনটেন্টবাজ পুরুষ একইভাবে কাঁদতে শুরু করলেন। জিনিসটা ঠিক কতটা উচ্চতা স্পর্শ করেছিল তা আপনি ‘ইমো বয়েজ় ওফ ইন্ডিয়া’, ‘রিপটাইলস অফ কুরলা’ ইত্যাদি পেজে গেলেই দেখতে পাবেন।
শুধুই কি স্টিরিয়োটাইপ ভাঙা? না, সঙ্গে পাশে দাঁড়ানোও রয়েছে।
যেহেতু ভারতের মোটামুটি সব আইন মেয়েদের পক্ষে তাই এই ইমো বয়েজ়রা দাঁড়িয়েছেন ছেলেদের পক্ষে। ভাই প্রত্যেকটি ভিডিয়োতেই প্রেমিকাকে বলছে, তোমার থেকে আমার মা অনেক ভালো অথবা প্রেমিকাকে হাত ধরে তার পুরনো প্রেমিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসছেন, বা প্রেমিকা ‘অসততা’ করছে জেনেও হাসিমুখে সব মেনে চুল ঠিক করে নিচ্ছে ইত্যাদি।
আপনি হয়তো এতে প্রবল পৌরষের বা পিতৃতান্ত্রিকতার ছাপ দেখতে পাচ্ছেন না। আমিও পাচ্ছি না। চুলের ওই বাহার এড়িয়ে, অন্য কোনও কিছুর ছাপ আমি দেখতে পাচ্ছি না। মাথার ডান পাশে চুল নেই আর বাঁ পাশের চুল কনুই অবধি গেছে। সবুজ রঙের। এই জিনিস ছেড়ে আপনি এত গভীরে ভাবতে যাচ্ছেনই বা কেন? আর যদি একান্তই ভাবতে চান তাহলে জোকারের ভিডিয়ো দেখুন।
হ্যাঁ একটি ছেলে যে বিশ্বাস করে ও জোকার। সার্কাসের নয় ব্যাটম্যানের। কোনও অজানা সাধনায় নিজের মুখের হাড় এবং মাসলগুলোকে ও বশ করে ফেলেছে। ‘গোল গোল’ বলে একটা মিউজ়িক বেজে উঠলেই ছেলেটি মুখমণ্ডলে শ্রাবস্তীর কারুকার্য এনে জোকার হয়ে যায়। আর এক ছেলে আছে, যাকে তার সকল প্রেমিকা কোনও অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে চলে গেছে। প্রতিটি ভিডিয়োতেই সেই প্রেমিকারা ছেলেটির কাছে ফিরে আসতে চায় কিন্তু ছেলেটি এখন আর তাদের পাত্তা দেয় না। কারণ সে বুঝতে পেরেছে প্রেমিকার থেকে চাষাবাদ বড়।
এই তো ক’দিন আগে একটি ভিডিয়োতে এক কাকু তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ কাকিমাকে পেটে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলেন এবং ভাইসি ভার্সা। যে কাতুকুতুতে হেসে ফেলবে সে হেরে গেল। খেলাটির নাম ‘গুদগুদি চ্যালেঞ্জ’। এ খেলায় বিজয়ী কী পুরস্কার পাবে তা অজানা থাকলেও এই ধরনের কনটেন্টই কি মানব সভ্যতার জন্য উপহার নয়? তার পর ধরা যাক গোলাপ ফুলের পকোড়া ভাজছেন একজন। একজন তাঁর মৃত স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখের গানে নাচছেন। অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। যারা সবাই আলাদা। সবাই অন্য রকম।
এ গিরগিটি পুষছে বলে ও সাপ পুষে দেখিয়ে দিল। হ্যাঁ জানি আপনার মতো কিছু ঈর্ষাকাতর, পরের ভালো দেখতে না পারা মানুষ ভাবছেন, এইগুলো দেখার সময় মনে হয় মানবসভ্যতা থেকে ‘সভ্যতা’ বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু মুশকিল হল, আপনি কিন্তু দেখছেন। একজন লোক গোবর দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছে, আপনি দেখছেন। একজন চানের ভিডিয়ো করে দেখাচ্ছে, আপনি দেখছেন।
অ্যানিমেশনে একজনের গলা হেলিকপ্টারের মতো হয়ে গিয়ে সে উড়ে চলে গেল, আপনি দেখছেন। আপনি দেখছেন একটি ছেলে ফাংশনে সাবান মাখতে মাখতে নাচছে। আপনি দেখছেন দুধের শিশুরা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে ভিডিয়ো কনটেন্ট বানাচ্ছে। ফুডব্লগিং-এর নামে চিলচিৎকার দেখছেন। সঙ্গে আপনি দেখছেন ম্যাগি ভেঙে বেসিন জুড়ে দিল, ঘোড়ার খুর কাটা হচ্ছে, কানের ময়লা বের করা হচ্ছে, ইত্যাদি প্রভৃতি ও অন্যান্য।