ভারতে গণতন্ত্র কি নামকেওয়াস্তে? আসলে কি এগিয়ে চলেছে একনায়কতন্ত্রী সমাজব্যবস্থার দিকে? প্রশ্ন তুলেছেন ধ্রুব রাঠী তাঁর ইউটিউব ভিডিয়োতে, যার ভিউ এই লেখা অবধি এক কোটি সত্তর লক্ষ। তিনি মোদী জমানার নানা ঘটনা তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ভারতে গণতন্ত্র কেন ক্ষীয়মাণ। ইভিএম কারচুপি, ঘোড়া কেনাবেচা, মূলধারার মিডিয়াকে কিনে নেওয়া, কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহার— রাঠীর বয়ানে সব রকম গণতন্ত্র-পরিপন্থী ঘটনার কথা।সামনেই লোকসভা ভোট, তাই মোদী-স্তব শুরু হওয়ার ক্ষণ অনতিদূরে। রাস্তা ঢাকবে কাট-আউটে, খবরের চ্যানেলে তাঁর দলের স্তুতি, মন্ত্রীদের ভাষণ— নিন্দুকে অবশ্য আত্মবিজ্ঞাপনের এই প্রবণতাকে হিটলার বা কাল্পনিক বিগ ব্রাদার্সের সঙ্গে তুলনা করবেন, কিন্তু তাতে কী? মানুষ তো তাঁকেই চায়! না চাইলেও চ্যানেল বাধ্য করবে। বাজারে যা হাওয়া, তাতে ভড়কে যাওয়া স্বাভাবিক।
ভাজপা থাকছে, মোদী না হলে কে-ই বা— যে বাক্য আসলে হওয়া উচিত প্রশ্নবোধক, তা হয়ে ওঠে নিঃশর্ত বিশ্বাস, সৌজন্যে মূলধারার মিডিয়ার শাসকপন্থী প্রচার। এ-ও ম্যানিপুলেশন। সেই পরিস্থিতিতে যে ভিডিয়োর গোড়ায় রাঠী বলছেন, মোদীর অন্ধভক্ত হলে এই ভিডিও না দেখাই ভালো, তার এত ভিউ ভাবায়। এই কোটি দুয়েক লোকের প্রত্যেকেই বিরুদ্ধ স্বর শুনতে চান, তা মোটেই নয়।
এঁদের মধ্যে মোদীভক্তও আছেন। আড়াই লক্ষ মন্তব্যে ‘দেশদ্রোহী পাকিস্তান চলে যা’-ধর্মী মন্তব্যও কম নয়। ভিউ থেকে মত আঁচ করা হয়তো বোকামি, কিন্তু ভিডিও তো অধিকাংশ দর্শককে অন্তত ভাবাতে সক্ষম হয়েছে। তা হলে কি মূলধারার মিডিয়ার বয়ানের বাইরেও যে ভারত আছে, তাকে জানার স্পৃহা টিকে আছে দেশবাসীর? পোস্ট-ট্রুথের জমানায় কি তা হলে নিজে ছানবিন করে আদত ঘটনায় পৌঁছনোর মানসিকতা আছে বৃহদংশের?
এক ইউটিউব ইউজ়ার লিখছেন: আগে অন্ধভক্ত থাকলেও রাঠীর ভিডিয়ো তাঁকে ভাবতে শিখিয়েছে, সরকারকে প্রশ্নাতীত ভাবে মেনে নেওয়ার আগে জেরা করতে শিখিয়েছে। উত্তরে কয়েকজন পাকিস্তান যাওয়ার নিদান দিয়েছেন। উপসংহারে আসতে পারি— এখানে বৃহত্তর আলোচনার দু’রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, যাদের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। এক দল সামান্য সমালোচনার গন্ধ পেলে চেনা লবজে আক্রমণ করতে আসেন, আর এক দল তলিয়ে দেখার সময় দিতে রাজি।
লক্ষণীয়, দ্বিতীয় দল গোড়াতেই একমত হতে চাইছেন না, সেটা হলে সমস্যাই। কিন্তু, ভাবতে পিছপা নন। তাদের মূলধারার সংবাদমাধ্যম নস্যাৎ করে দিলেও, ‘বিরোধের সম্ভাবনা নেই’ বলে জনসংখ্যার বড় অংশকে খারিজ করলেও, এঁরা আছেন। সত্যকে খারিজ করা ফ্যাসিস্ট প্রবণতা। এত মানুষের বিরোধী মতামত, সরকারের সমস্ত গাফিলতি ও অপরাধকে উপেক্ষা করা সৎ সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়। কিন্তু প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে আসে ‘সত্য’-এর কাছে।
পাল্টা প্রশ্ন: রাঠী কি সব সত্যি বলছেন? তিনি কি বিকল্প হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করতে পারছেন? এই ভিডিয়োর তাঁর বিরুদ্ধেও সমালোচনার ঢল। অনেকে বলছেন, রাঠী কেজরিওয়ালের বেসরকারি মুখপাত্র, তিনি আপ-এর ভুল দেখতে পান না। বস্তুত, আমি এখানে রাঠীর মুখপাত্র নই, তাঁর তর্কে অতি-সরলীকরণের প্রবণতা আছে, দ্রুত উপসংহারে আসার সমস্যা আছে। কিন্তু রাঠীর ভিডিয়ো নিয়ে হইচই কি বাজার-নির্মিত হল্লা নয়? অবশ্যই।
সে তর্ক অন্যত্র, তবে এই সমস্যাগুলি মেনে নিয়েও বলতে হয়, বক্তব্যের নির্যাস জরুরি— রাঠী বলছেন না বিরোধীদের ভোট দাও, বলছেন বিরোধীদের কথা বলার জায়গা দাও। বলছেন না, আমার কথা ধ্রুব মানো; বলছেন, আমাকেও যুক্তিতে ফালাফালা করো। কিন্তু, ভাবো। মজা হল, তাঁর যুক্তি খণ্ডন করতে গেলেও ইতিহাসে তাকাতে হবে, অতীতের রাষ্ট্রশক্তির আস্ফালনের নজির খুঁজতে হবে। এই কাজগুলিতে যে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ হয়, তা থেকে গড়ে ওঠে গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ: সচেতন নাগরিক।
পাশাপাশি ইউটিউব-এর অ্যালগোরিদম আছেই। রাঠীর ভিডিয়ো থেকে তারা এগিয়ে দেয় সমদিশ ভাটিয়ার দিকে। ভাটিয়া তাঁর চ্যানেলে ‘ভারত: এক খোঁজ’ নামে শো চালান, সেখানে উলঙ্গ, না খেতে পাওয়া ভারতের কাছে যান। যাঁদের কণ্ঠস্বর শোনে না মূলধারা বা সমান্তরাল, তিনি শোনেন। জানতে পারেন, তাঁরা ক্ষুব্ধ প্রতিটি সরকারের উপর। তাঁরা সব পার্টিকে ঘৃণা করেন। রাঠীর ভিডিয়ো পৌঁছে দেয় বরুণ গ্রোভারের টক শোয়ে, যেখানে বরুণ নৈরাশ্যবাদী হয়ে বলেন আসন্ন সংকটের কথা।
সমতুল্য আঞ্চলিক ভাষার কনটেন্টে এগিয়ে দেয় ইউটিউব— চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ‘১৯৮৪’ ও ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর উদাহরণ দিয়ে ডিস্টোপিয়ার কথা বলেন, আমরা চারপাশকে উপন্যাসের সঙ্গে মেলাতে পেরে আঁতকে উঠি। কিন্তু সকলেই আমাদের ভাবতে বলছেন, কাট-আউটের ঝলকানি পেরিয়ে প্রকৃত চিত্রের দিকে তাকাতে বলছেন।
সমীক্ষা বলছে, সারা পৃথিবীতে সব থেকে বেশি ইউটিউব দর্শক ভারতেই— ৪৬.৭ কোটি। তাদের মধ্যে, বিশেষত কোভিড-পরবর্তী সময়ে, ১৮-৩৫ বছর বয়সিরাই বেশি। ধরে নিতে পারি, এই ভিডিওগুলো বেশি করে পৌঁছোচ্ছে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় ভোটারদের কাছেই। তাঁরা কি শুনছেন? তাঁরা কি আপাতত নিশ্চুপ হলেও ধীরে ধীরে ভাবা শুরু করছেন?
সংখ্যাকে একেবারে ফেলে দেওয়াও কোনও কাজের কথা নয় কিন্তু। সংখ্যা যদি একটা সূচক হয়, এখনই খুব বেশি নৈরাশ্যবাদী হওয়ার কারণ নেই। ইতিহাস বইয়ে তো আমরা সকলেই পড়েছি সেই বিখ্যাত উক্তি: দুষ্টের আস্ফালনে নয়, বরং শিষ্টের নীরবতাতেই দুনিয়ার ক্ষতি হয় বেশি। নিদ্রিত ভারত কি জাগবে?