ইংরেজিতে যাকে বলে আপারহ্যন্ড, তাই নিল বিজেপি। প্রথমেই টেক্কা দিল ইন্ডিয়া জোটকে। ১৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রার্থী তালিকা শনিবার বের করল বিজেপি। যে তালিকার প্রথম নাম নরেন্দ্র মোদীর। ৩৭০ আসন জেতার লক্ষ্যে ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগেই শনিবার ১৯৫ আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দিল পদ্ম শিবির। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ২০টি আসনের প্রার্থীর নাম প্রকাশ করল বিজেপি। যাকে ব্রেন স্টর্মিং, তা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় শাহ-নাড্ডার উপস্থিতিতে রাজ্যগুলোর কার্যকর্তাদের বৈঠক।সে বৈঠক গড়ায় শুক্রবার ভোর রাত পর্যন্ত। নরেন্দ্র মোদী সাধারণভাবে খুবই নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী। কিন্তু সেই মোদীও রাত কাবার করে দেন প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে। তারপরই তিনি উড়ে আসেন দু'দিনের বাংলা সফরে। এই দীর্ঘ সময় নেওয়া আর মোদীর অনিয়ম করা বুঝিয়ে দেয় প্রার্থী নির্বাচনে দলের মধ্যে একটা সাধারণ ফর্মুলা কাজ করেনি, ইফস অ্যান্ড বাটস কাজ করেছে। নিক্তিতে মেপে বুঝতে হয়েছে, কাকে কাকে প্রার্থী করলে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে।
আসলে ৩৭০ আসনের টার্গেট থেকে এক কদম দূরে থামতে নারাজ মোদী-শাহ। খেয়াল করে দেখুন, শনিবার কৃষ্ণনগরের সভায় মোদী বাংলার জন্য অমিত শাহর বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা সাইড করে দিয়ে তিনি ৪২-এ বিয়াল্লিশ টার্গেট দিয়ে গেলেন শুভেন্দু-সুকান্তকে। কী হবে তা পরে দেখা যাবে। আর এই অভীষ্ট থেকেই বাংলার ঘোষিত ২০ প্রার্থীর মধ্যে ৪জন বিধায়ককে এবার লোকসভা আসনে প্রার্থী করল দল। ২০১৯ সালে মালদহ দক্ষিণে মাত্র ৮,২২২ ভোটে হেরেছিলেন বর্তমান বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী। তাঁকে এবার আবার সেখান থেকে প্রার্থী করা হয়েছে। বিধানসভায় বিজেপির চিফ হুইপ মনোজ টিয়াকে আলিপুরদুয়ার কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করা হয়েছে। আলিপুরদুয়ারের বর্তমান সাংসদ জন বার্লাকে এবার টিকিট দিল না বিজেপি। বার্লাকে টিকিট না দেওয়ার কোনও কারণ দলগতভাবে জানানো হয়নি।
তবে আমরা জানি, তিনি উত্তরবঙ্গের ৪টি জেলা নিয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছিলেন। সেই দাবির কথা শুনে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন মোদী ও অমিত শাহ। যদিও এমন বিচ্ছিন্নতাবাদের কথা শোনা যায় এবং আন্দোলনও করেন, এমন সংগঠন ও ব্যক্তির সঙ্গে কিন্তু এই বিজেপি নেতৃত্ব অনেক সময়ই সম্পর্ক গড়ে তোলে বিরোধীদের টাইট দিতে। তাই, আমার ধারণা বার্লা গেরুয়া কর্তাদের তুষ্ট করতে পারেননি। এছাড়া বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষকে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে টিকিট দিল বিজেপি। আরেক বিধায়ক হিরণ্ময় চট্টোপাধ্যায়কে (হিরণ) ঘাটাল কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়েছে।
তবে দলীয় সূত্রে খবর, যদি ঘাটালে তৃণমূলের তরফে দেবকে প্রার্থী করা হয় তাহলে হিরণই তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী থাকবে। অর্থাৎ নায়কে-নায়কে যুদ্ধ। অন্যথায় তালিকায় নাম থাকলেও হিরণের বিকল্প অন্য কাউকে প্রার্থী করার ফন্দি এঁটে রেখেছেন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। বহরমপুরে প্রার্থী হলেন ডাক্তার নির্মলকুমার সাহা। চিকিৎসক হিসেবে বহরমপুরে বেশ পরিচিতি রয়েছে নির্মলবাবুর। রানিবাগানে নিয়মিত চেম্বার করেন ডাক্তারবাবু। এছাড়াও শহরের একাধিক নার্সিংহোমে রোগী দেখেন তিনি। তবে রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনও যোগ নেই। যদিও বিজেপির টিকিট পাওয়ার পরেই তিনি বলেন, 'আমি রাজনীতিতে ছিলাম না এটা বললে আমি স্বীকার করব না। কারণ প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনা রয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষ নিজের মতো করে রাজনীতি করেন। তবে এটা ঠিক, ডাক্তারি করতাম। অ্যাকটিভ পলিটিক্সে ছিলাম না।'
ছিলেন না, তাই সহজেই স্বীকার করেছেন, অধীরের সঙ্গে লড়াই করাটা কঠিন হবে। এখানে মজার জিনিস, অধীরের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন দুবলা প্রার্থী কেন? তবে কি এটাও সেই সেটিং তত্ত্ব? ২০১৯-এও আমরা দেখেছি, অধীরের বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী ছিলেন দিলীপ ঘোষের বাড়ির পুরোহিত। এমন কথাও চালু আছে, অধীরের জেতার পিছনে দিলীপের অবদান আছে। যাক, বিজেপির কাঁথির প্রার্থী কিন্তু প্রত্যাশিতই ছিল শুভেন্দু অধিকারীর ভাই সৌমেন্দু অধিকারী। অনুপম হাজরার কপাল অনেকদিনই পুড়েছে, তাই যাদবপুরে এবার গেরুয়া শিবির প্রার্থী করেছে শ্যামাপ্রসাদ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর অনির্বাণ গাঙ্গুলিকে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্যে থাকার সময় বিজেপির সমর্থক ও কর্মীদের একাংশ বাঁকুড়া থেকে সুভাষ সরকারকে যাতে প্রার্থী না করা হয় তার দাবি তুলেছিলেন।
রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ক্ষোভও জানিয়েছিলেন। পোস্টার পড়েছিল সুভাষ সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু দল সুভাষ সরকারকেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে। আসানসোল থেকে শত্রুঘ্ন সিনহার বিরুদ্ধে ভোজপুরি গায়ক পবন সিংকে প্রার্থী করে বিজেপি দুই বিহারির লড়াই জমিয়ে দিতে চাইছে। কোচবিহারে প্রার্থী হয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক ও বালুরঘাটে বঙ্গ বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারই ফের প্রার্থী। লকেটকে নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক, হুগলি থেকে তাঁকেই প্রার্থী করেছেন মোদী। হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র ও প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ভোলানাথ চক্রবর্তীর ছেলে রথীন চক্রবর্তীকে প্রার্থী করা হয়েছে। বোলপুর কেন্দ্রে নতুন মুখ প্রিয়া সাহা। বাকি আসনে বিশেষ কোনো বদল নেই।
যে ২০টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা হয়েছে, তার মধ্যে ১১টি বিজেপির জেতা আসন। তবে সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গের, যেখানকার ৭টি আসনই ২০১৯-এ জিতেছিল বিজেপি, সেখানকার রায়গঞ্জে প্রাক্তন মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীকে এবার প্রার্থী নাও করতে পারে বিজেপি। যতই দেওয়াল লেখা শুরু করুক, জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায় ও দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তকেও প্রার্থী না করার পক্ষেই বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এর একটা সাধারণ কারণ, বিজেপি এই কেন্দ্রে কোনও জেতা সাংসদকে দ্বিতীয়বার প্রার্থী করেনি।
এবার ফেরা যাক একটু জাতীয় প্রেক্ষাপটে। ১ মার্চ ভোররাত পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নির্বাচনি কমিটির বৈঠকে প্রার্থী তালিকা প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেই বৈঠকেই মোটামুটি প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয়ে যায়। দলের সদর দফতরে সাধারণ সম্পাদক বিনোদ তাওড়ে ঘোষণা করেন প্রার্থী তালিকায় প্রথম নাম রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। এই নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য বারাণসী কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হচ্ছেন তিনি। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবারও প্রার্থী হচ্ছেন লালকৃষ্ণ আদবানির ছেড়ে আসা গুজরাতের গান্ধীনগর থেকে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং প্রার্থী হচ্ছেন উত্তর প্রদেশের লখনউ থেকে। এছাড়া লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লার নামও প্রার্থী তালিকায় আছে। তাওড়ে বলেন, প্রথম তালিকায় ৩৪জন কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর নাম আছে। এর মধ্যে ২৮ জন হলেন মহিলা। ২৭ জন তপশিলি জাতি।
১৮ জন তপশিলি উপজাতি ও ৫৭ জন ওবিসি। প্রার্থীদের মধ্যে ৪৭ জনের বয়স ৫০'এর নীচে। মধ্য প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, যাঁকে এবার ভোটে জিতে বিজেপি ফের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসায়নি, তাঁকে লোকসভায় প্রার্থী করল বিজেপি। আরো এক বড়ো চমক হল কেরালা থেকে কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রবীণ নেতা এ কে অ্যান্টনির ছেলে অনীল অ্যান্টনিকে লোকসভা আসনে দাঁড় করাল বিজেপি। রাহুল গান্ধীর ওয়েনাড় কেন্দ্রে এখনো কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি। শোনা যাচ্ছে, রাহুল যদি শেষ পর্যন্ত ওয়েনাড় থেকে প্রার্থী হন, তাহলে কোনো হেভিওয়েটকে টিকিট দিতে পারে দল। তবে গান্ধী পরিবারের হাত থেকে খোওয়া যাওয়া উত্তরপ্রদেশের আমেঠিতে এবারও প্রার্থী হচ্ছেন রাহুল-বিজয়ী স্মৃতি ইরানি। দিল্লিতে ৫টি আসনের ৪টিতেই বদল করা হয়েছে।
প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের মেয়ে বাঁশরী স্বরাজকে নতুন দিল্লি থেকে প্রার্থী করল দল। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী মীনাক্ষী লেখিকে দিল্লি থেকে এবার আর প্রার্থী করেনি বিজেপি। পূর্ব দিল্লি থেকে প্রার্থী হননি গৌতম গম্ভীর। শনিবার সকালেই গম্ভীর দলের সভাপতি জে পি নাড্ডাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এবার ভোটে প্রার্থী হতে চান না। তিনি লিখেছেন, ক্রিকেটে আরো সময় দেওয়ার উদ্দেশেই তিনি আর ভোটে দাঁড়াতে চান না। হয়ত তাই। তবে এ-ও শোনা যাচ্ছে গৌতম গম্ভীর আর রাজনীতিতে থাকতে চান না। এছাড়া আন্তর্জাতিক আবহাওয়া ও পরিবেশবিদ সাংসদ জয়ন্ত সিনহাও নাড্ডাকে চিঠি লিখেছেন।
তিনি বলেছেন, গবেষণার কাজে আরো সময় দিতে চান। তাই এবার ভোটে দাঁড়াতে চান না। হাজারিবাগের এই বিজেপি সাংসদের আরেকটি পরিচয় তিনি যশবন্ত সিনহার ছেলে, যে যশবন্ত সিনহা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধীদের প্রার্থী ছিলেন। কংগ্রেসের শশী থারুরের জেতা আসন তিরুবনন্তপুরম থেকে প্রার্থী হচ্ছেন বর্তমান রাজ্যসভার সদস্য ও কেন্দ্রীয়মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর। বিতর্কিত নেত্রী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে টিকিট দেয়নি দল। তিনি প্রায়ই দলের লাইনের বাইরে গিয়ে নানান বিতর্কিত মন্তব্য করে থাকেন বলে পছন্দ নয় মোদী-শাহর। হেমা মালিনীকে টিকিট দেওয়া হবে না শোনা গেলেও এবারও তাঁকে মথুরা থেকে প্রার্থী করা হয়েছে।
কৃষ্ণনগরের জনসভা থেকে মহুয়াকে কটাক্ষ সুকান্ত মজুমদারের
লখিমপুর খেরি থেকে ফের টিকিট দেওয়া হল বিতর্কিত অজয় মিশ্র টেনিকে। এছাড়া অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয়মন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালকে এবারও ডিব্রুগড় থেকে টিকিট দিয়েছে দল। অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া তাঁর পুরোনো আসন মধ্য প্রদেশের গুনা কেন্দ্র থেকে এবারও প্রার্থী হচ্ছেন। বিজেপির দাবি, সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার কথা মাথায় রেখেই প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। বিজেপির এবার টার্গেট ৩৭০ আসনে জয়ী হওয়া। এছাড়া এনডিএকে নিয়ে ৪০০ আসন পার হওয়ার লক্ষ্যই হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। ২০১৯ সালে ৭ দফা ভোটের নির্ঘণ্ট নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করার পরই প্রার্থী তালিকা ঘোষিত হয়েছিল। এবার রেকর্ড আসন জয়ের লক্ষ্যে নির্ঘন্ট ঘোষণার আগেই ১৯৫ আসনের তালিকা ঘোষণা করল মোদীর দল।
(এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত লেখকের ব্যক্তিগত মতামতে। 'এই সময় ডিজিটাল' এর দায়ভার কোনও ভাবেই বহন করে না।)