রাত ৮টা বাজার ১০ মিনিট আগে হাওড়া থেকে ব্যান্ডেলের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ট্রেনটার। সন্ধে সাড়ে ৭টার পর থেকেই ভিড় জমতে শুরু করেছিল ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন ছাড়ার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকল না দেখে ডেলি প্যাসেঞ্জাররা ধৈর্য হারিয়ে পূর্ব রেলের উদ্দেশে প্রয়োগ করতে শুরু করলেন বাছা বাছা মন্তব্য এবং বিশেষণ। যেগুলো মোটেও শ্রুতিমধুর নয়। শেষ পর্যন্ত ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকল রাত ৮টা ২০ মিনিট নাগাদ। টাইম টেবিল অনুযায়ী, ওই ট্রেনের তখন কোন্নগর ছেড়ে যাওয়ার কথা!
লোকাল ট্রেনের কোনও একদিন এই ভাবে আধ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ার ঘটনাকে আদৌ ‘ব্যতিক্রমী’ হিসেবে দেখছেন না পূর্ব রেলের, বিশেষ করে হাওড়া স্টেশনের নিয়মিত যাত্রীর দল। তাঁদের দাবি, বিকেল ৫টা বেজে যাওয়ার পর শেষ কবে হাওড়া থেকে কোন ট্রেন সময়ে ছেড়েছে এবং কারশেডের ‘মরণ ফাঁদে’ না-পড়ে ঠিকঠাক হাওড়ায় ঢুকেছে, সেটা মনে পড়ে না। কিন্তু কেন লোকাল ট্রেন সময়ে চলা বন্ধ করে দিয়েছে বহু দিন? মাসের পর মাস হাওড়ার নিত্যযাত্রীরা জঘন্য পরিষেবায় বিরক্ত হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের মন্তব্য প্রকাশ করার পরেও কেন টনক নড়ছে না পূর্ব রেলের কর্তাদের?
পূর্ব রেলের হাওড়া ডিভিশন গত বছর খানেক ধরে ধারাবাহিক ভাবে জঘন্য পারফরম্যান্সের যে নজির গড়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে সংস্থা চিহ্নিত করেছে কয়েকটি বিষয়কে। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র বলছেন, ‘পূর্ব রেলে প্রায় ৬০০-র কাছাকাছি লেভেল ক্রসিং। আমাদের ট্র্যাক ইঞ্জিনিয়াররা দেখেছেন, অনেক সময়েই এই লেভেল ক্রসিং বন্ধ করা নিয়ে সমস্যা হয়। ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু দু’দিকের ট্র্যাফিকের জন্য গেট নামানো যায় না। এর ফলে এক-একটা ট্রেন ২০ মিনিট পর্যন্ত মার খায়।’হাওড়া স্টেশন থেকে প্রতিদিন আপ ও ডাউন মিলিয়ে ৪৬২টি লোকাল ট্রেন চলে। বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা— এই সময়সীমার মধ্যে চলা ট্রেনগুলোর গুটি কতকও যদি লেভেল ক্রসিংয়ের ফাঁদে পড়ে যায়, তা হলে গোটা সিস্টেমটাই ঘেঁটে যায় বলে পূর্ব রেলের কর্তারা জানাচ্ছেন। সিপিআরও-র আরও বক্তব্য, ব্যস্ত সময়ে বহু স্টেশনেই লোকাল ট্রেনকে যাত্রীদের ওঠানামার জন্য নির্ধারিত ৩০ সেকেন্ডের চেয়ে কিছুটা বেশি সময় দাঁড়াতে হয়। এই দু’টি কারণেরই অনিবার্য ফল হলো: ‘পাথওয়ে কনজেশন’। একবার একটা ট্রেন ‘মার খেতে’ শুরু করলে তার পিছনে থাকা ট্রেনগুলোর সময়ানুবর্তিতার উপরেও সেই প্রভাব পড়বে।
তবে আধিকারিকদের এই যুক্তি মানতে নারাজ পূর্ব রেলেরই কর্মীদের একটা বড় অংশ। তাঁরা বলছেন, লেভেল ক্রসিং তো আগেও ছিল, তখন তো এই সমস্যা হতো না! পূর্ব রেলের কর্মীদের সংগঠন, ইস্টার্ন রেলওয়ে মেন্স ইউনিয়নের (ইআরএমইউ) সাধারণ সম্পাদক অমিত ঘোষ বলছেন, ‘সময়ানুবর্তিতা, সুরক্ষা এবং পরিকাঠামো— রেলের প্রধান স্তম্ভ এই তিনটি বিষয় এখন আর গুরুত্ব পায় না। কর্তারা এখন ব্যস্ত জাঁকজমকের উদ্বোধনে। তারই পরিণতিতে যাত্রীদের এমন দুর্ভোগ। অবস্থা এখন এমন যে, কর্মীরা ট্রেনে যাতায়াত করার সময়ে নিজেদের রেলকর্মী বলে পরিচয় দেন না, পাছে হেনস্থা হতে হয়, সেই ভয়ে।’
লোকাল ট্রেনের সময়ানুবর্তিতার গোল্লায় যাওয়া নিয়ে কর্মীদের অনেকের বক্তব্য, ‘গত কয়েক বছরে হাওড়ায় ট্রেনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু লাইন বাড়েনি। সন্ধের দিকে যখন বেশি করে লোকাল ট্রেন দিতে হয়, তখনই প্রকট হয় সমস্যা। প্ল্যাটফর্ম খালি থাকে না বলে ট্রেনগুলো কারশেডে দাঁড়িয়ে থাকে।’ কর্মীদের একাংশের সাফ কথা, ‘টাইম মেনে চলা দূরের কথা, ট্রেন যে চলছে, সেটাই অনেক।’
কর্মীরা জানাচ্ছেন, শিয়ালদহের তুলনায় হাওড়ায় লোকাল ট্রেনের সমস্যা অনেক বেশি। কারণ, হাওড়ায় দূরপাল্লার ট্রেন অনেক বেশি সংখ্যায় চলে। মেল/এক্সপ্রেস ট্রেন যে প্ল্যাটফর্মে ঢোকে, সেটা অন্তত ৩০-৪০ মিনিটের জন্য আটকে থাকে। তখন আর লোকাল ট্রেন সেই প্ল্যাটফর্মে ঢোকানো যায় না।