আইবুড়ো ভাত থেকে বিয়ে, বৌভাত। হাল আমলের মেহেন্দি, সঙ্গীতের চক্করে তালিকাটা আরও লম্বা হয়েছে। এক কথায়, বিয়ে মানে একটা গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন! আর সেই সেলিব্রেশনে ছবি, ভিডিয়ো থাকবে না, তাই কি হয়? সাবেক কালের বিয়েবাড়ি থেকে হাল আমলের ম্যারেজ সেরিমনি-ফোটোগ্রাফারের কদর তাই সবচেয়ে বেশি। বিয়ে বাড়ির ক্যানডিড মুহূর্ত ধরে রাখা, সুন্দর করে বানানো ভিডিয়ো, নবদম্পতির ফেসবুক-ইনস্টার জন্য বানিয়ে দেওয়া রিল—এক কথায় ফোটোগ্রাফারের এখন বিরাট দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ব সুচারুভাবে নেওয়ার জন্য কাঁধটা যে সব সময়ে পুরুষোচিত চওড়া হতে হবে, ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়।আজকালকার বিয়ে, প্রি-ওয়েডিং শুট থেকে বেবি শাওয়ার—ক্যামেরা কাঁধে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন মহিলা প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফাররাও! আগে যে সংখ্যাটা ছিল হাতে গোনা, এখন সেটাই হাতের কর পেরিয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে ডানা ছড়াচ্ছে অর্ধেক আকাশ। এই যেমন আন্দুলের রঞ্জুরীমা দাস। ৩২ বছরের রঞ্জুরীমার প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি মাত্র ১৭-১৮ বছর বয়সে। প্রথমে শখের স্ট্রিট ফোটোগ্রাফি করতেন। এক আত্মীয়ের বিয়ের সূত্র ধরে ওয়েডিং ফোটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি। ব্যাপারটা এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল, সেটাকে আর ছাড়তে চাননি রঞ্জুরীমা।
বললেন, ‘২০১৩ সালে কয়েকজন ফোটোগ্রাফার বন্ধুর সঙ্গে গুজরাট গিয়েছিলাম, রয়্যাল ওয়েডিংয়ের ছবি তুলতে। সেখানে অনেক কিছু শিখেছি। এখন ড্রোন হয়েছে, তখন এ সব ছিল না। শিখেছি, কী ভাবে ক্রেন ব্যবহার করে ড্রোনের মতো উপর থেকে শট নেওয়া যায়। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কাজ করেছি। ধীরে ধীরে কলকাতায়, শহরতলিতে অ্যাসাইনমেন্ট বেড়েছে।’ রঞ্জুরীমা জানালেন, প্রথাগত বিয়ের ছবি তোলায় আগ্রহী নন তিনি।
তাঁর কথায়, ‘বিয়ের পুরো বিষয়টা একটা গল্পের মতো। ভোরবেলা চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে ঠাকুরের রান্না—আমার কাছে ওয়েডিং ফোটোগ্রাফি একটা স্টোরি টেলিং ডকুমেন্টারি। এখন অনেকেই এই ট্রেন্ড পছন্দ করছেন। তাঁরাই আমাকে ডাকেন।’ ২০১৫ সাল থেকে ‘Fotocreation’ নামে নিজেদের কাজ সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করছেন রঞ্জুরীমা এবং তাঁর টিম, সাড়া পেয়েছেন ভালোই। বিয়ের পরও প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফি চালিয়ে যেতে পারবেন, এই শর্তেই খুঁজেছেন জীবনসঙ্গীও।
বাড়ির সাপোর্ট পেয়েছিলেন বলে এই পেশায় এগোতে পেরেছেন অদ্রিজা ভট্টাচার্যও। ২৩ বছরের অদ্রিজা ভাটপাড়ার মেয়ে। জানালেন, ২০১৯ সাল থেকে প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফি করছেন। অদ্রিজার কথায়, ‘বিয়ে বলুন বা অন্য অনুষ্ঠান, মহিলাদের আচারই বেশি, ফলে তাঁরা অনেকেই মহিলা ফোটোগ্রাফার বেশ পছন্দ করেন। বিশেষ করে কনে সাজানোর সময়ে বা মা-মাসিমাদের নিয়ম পালনে অনেক ক্যানডিড মুহূর্তের ছবি আমরা তুলতে পারি, যেখানে পুরুষ ফোটোগ্রাফার এন্ট্রি পান না।’
কিন্তু সবই কি এতটাই পজিটিভ? কয়েনের উল্টো পিঠের কথাও শোনালেন রঞ্জুরীমা, অদ্রিজা। যে কোনও ইভেন্ট রাতে শেষ হলেও ফেরার গাড়ির ব্যবস্থা সব সময়ে থাকে না। ফলে নিজেদের স্কুটি বা অ্যাপ বাইক-গাড়ি ভরসা। নিরাপত্তা নিয়ে অবশ্য তাঁরা কেউই বিশেষ ভাবিত নন। তবে পিরিয়ডসের দিনগুলোতে কাজ পড়লে একটু সমস্যা যে হয়, মানছেন শ্বেতা পাল। বছর চব্বিশের শ্বেতার টিমের নাম ‘The Bliss Bunch’।
বারাসতের শ্বেতার কথায়, ‘আগে শর্টফিল্ম বানাতাম, সেই থেকে ক্যামেরার কাজকে ভালোবাসা। তার পর ধীরে ধীরে ফোটোগ্রাফি প্রফেশনে আসা। কাজটাকে খুবই এনজয় করি। কিন্তু ওয়েডিং শুট হোক বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান, আমাদের কাজটা পুরোদস্তুর দৌড়ঝাঁপের। ফলে, কাজের দিনে পিরিয়ডস হলে খুবই কষ্ট হয়। তার উপর সব জায়গায় টয়লেট ততটা পরিষ্কার থাকে না। কাজের স্বাস্থ্যকর পরিবেশটা এই পেশায় মেয়েদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ তার পরও মেয়েরা যে থেমে থাকছে না, তার দৃষ্টান্তও দিলেন শ্বেতা। তাঁর টিমে এখন ৪০ জন কাজ করেন, যার অধিকাংশই মহিলা।
বেহালার বাসিন্দা, বছর তিরিশের সুকন্যা দাশগুপ্তও ক্যামেরা কাঁধে বেশ ব্যস্ত। কাজের ফাঁকেই জানালেন, ২০১৬ থেকে এই প্রফেশনে রয়েছেন। কলকাতাকে কখনও অ-নিরাপদ মনে হয়নি। তবে সুকন্যার কথায়, ‘এই পেশায় মনে সাহস রাখাটা খুব দরকার। প্রতিকূলতা সব পেশাতেই রয়েছে, সেটাকে কাটিয়ে ওঠাটাই চ্যালেঞ্জ। আর সেক্ষেত্রে বাড়ির সাপোর্টটা খুব দরকার, যেটা আমি পেয়েছি।’
এখন বিয়ের পাশাপাশি প্রি-ওয়েডিং শুট, মেটারনিটি শুট, অন্নপ্রাশন, বাচ্চার এক বছরের জন্মদিনে ফোটোশুট— এই ট্রেন্ডগুলো বেড়েছে, মানছেন সকলেই। কিন্তু এখনও অনেক সময়ে যথাযথ পারিশ্রমিক মেলে না, সেই সঙ্গে তাঁদের পেশায় অভিজ্ঞতার নিরিখে কাজের মূল্যায়ন বা সার্টিফিকেটের তেমন ব্যবস্থা নেই— সে সমস্যাও উঠে এলো কথায় কথায়। তবু আশা ছাড়েন না রঞ্জুরীমা, সুকন্যারা। লেন্সে চোখ রেখে খুঁজে চলেন ক্যানডিড মূহূর্ত। তাঁদের চোখেই যে ধরা থাকে স্পেশ্যাল ডে-র বিশেষ মুহূর্তগুলো…।