• সংসারের হাল ফেরাতে সংসার কাঁধে নিয়েই ঘোরেন ওঁরা
    আজকাল | ০৯ মার্চ ২০২৪
  • রিয়া পাত্র ওঁরা ঘর দোর সামলান, সংসারের কাঁথা থেকে মাদুর, চালের বস্তা থেকে ছেলে মেয়ের শাক-ভাত, আগলে রাখেন। একই সঙ্গে মেলায় বসে বোনেন ঝুড়ি-ধামা। কারও কোলে এক শিশু, পাশে শুয়ে আরেকজন। কারও বয়স পেরিয়েছে ৫০, কোমরে ব্যথা, চোখে ছানি, তার মাঝেই ঘাড় নিচু করে কাজ করে চলেছেন। শহর বা মফঃস্বলের যে কোনও হস্তশিল্পের মেলায় গেলেই তাঁদের দেখা মিলবে। যেমন বহরমপুরের সরস্বতী, কিম্বা করিমপুরের পুতুল। সংসারের হাল ফেরাতে সংসার কাঁধে নিয়েই ঘোরেন ওঁরা। সঙ্গে থাকে বাঁশ, বেত, কাটারি, দা, ঝুড়ি, রং, কাপড় আর কোলের সন্তান।দক্ষিণ দিনাজপুরের যমুনা বৈশ্য, বিয়ের আগে বাড়িতে কাঠের কাজ করতে দেখতেন বাবা-কাকাদের। মাঝে মাঝে হাত মেলাতেন। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। বানান ফুলদানি, মুখোশ, ল্যাম্পশেড। সঙ্গে সামলাচ্ছেন তিন ছেলেকে। একজনের বয়স ১৭, একজন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে, একজন এখনও প্রাইমারির গন্ডি পেরোয়নি। পরের দুজন তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই ঘোরে জেলায় জেলায়। ষষ্ঠ শ্রেণী পাশ যমুনা কাজের সঙ্গে সঙ্গে সামলাচ্ছেন পরিবার। মেলায় মেলায় যাচ্ছেন হাতের কাজ নিয়ে। শহরের লোকেরা কাজ দেখে মুগ্ধ হলে তাঁর ভাল লাগে। কিন্তু চান, তাঁর ছেলেরা যেন লেখাপড়া করে অন্য কিছু করতে পারে। বহরমপুরের মালা শুধু মেয়ে নয়, নাতনিকেও সঙ্গে এনেছেন। মেয়ে তাঁর সঙ্গে ঝুড়ি বুনছেন, মায়ের দেখাদেখি বছর চারেকের শিশু পাশে পড়ে থাকা কাটারিতে হাত দেয়। বাচ্চা কোলে মেলায় মেলায় ঘুরতে সমস্যা অনেক তো? প্রশ্নের জবাবে হেসে জানালেন, ‘অসুবিধা তো হয়, তবে আমরা এভাবেই অভ্যস্ত। বাড়িতে থাকলে আমরা ঘরে বসে কাজ করি।‘ টুম্পা যেমন মেলার দিনগুলোতে মেয়েকে সঙ্গে নেন না। তাঁর একটাই কথা, ‘ওরা একটু লেখাপড়া শিখুক।‘ টুম্পা ব্যাধ এখনও স্বপ্ন দেখেন, ঝুড়ি বোনার পাশাপাশি অন্য কিছু করবেন। বছর ৩০-এর মাম্পি ছোট থেকেই এই কাজ করছেন। পরীক্ষার জন্য আগের মেলায় ছেলে-মেয়েকে আনতে পারেননি। ঝুড়ি, পাখা তৈরি করতে করতে মাঝে মাঝে মন চলে যায় গাঁয়ের ঘরে। ফোন করে খোঁজ নেন, সবাই কেমন আছে। নবম শ্রেণীর আলপনা বাবা-মা-কাকিমার মতো ঝুড়ি বানালেও, সে স্বপ্ন দেখে কলেজে পড়বে, অফিসে যাবে একদিন। কাজ করতে করতেই নিচু স্বরে জানাল, ‘পড়াশোনায় ক্ষতি হয়, তবু কাজ করতেই হয়, তার মাঝেই পড়ি। স্কুল কামাই হয়, বন্ধুদের থেকে পড়া বুঝে নিই‘। নদীয়ার মিতালির ছেলে-মেয়ে দু’ জনেই খুব ছোট। তাদের একজন কোলের থেকে নামতেই চায় না, তাকে কোলে নিয়েই কাজ করতে হয়, মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে মায়ের আঁচল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মেলাতেই। এরকম আরও অনেকে আসেন, কেউ আঁকেন পটচিত্র, কেউ বানান মাটির জিনিস। এভাবেই পেরোয় মেলা। শেষ হলে ঘরে ফেরা, যাযাবর সংসার নামিয়ে রাখা গেরস্থের মেঝেয়। তারপর আবার মেলা, আবার কাঁধে সংসার তুলে পথ চলা।
  • Link to this news (আজকাল)