ভবানীপুরের ব্যবসায়ী খুনে নিখুঁত ছক! অভিযুক্তের বয়ানে হতবাক পুলিশ কর্তারাও
প্রতিদিন | ১৪ মার্চ ২০২৪
অর্ণব আইচ: ভবানীপুরের ব্যবসায়ী খুনে হাড়হিম করা চিত্রনাট্য। যা হার মানাবে সিনেমাকেও। ঠান্ডা মাথায় কীভাবে খুনের ছক সাজিয়েছিলেন অভিযুক্ত অনির্বাণ গুপ্ত? পুলিশের তদন্তে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য।
পুলিশ সূত্রে খবর, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খুনের নিখুঁত ছক সাজিয়েছিলেন ‘খুনি’ অনির্বাণ গুপ্ত। যাতে ট্যাঙ্কের তলায় বাঁধানো জায়গায় দেহ লুকিয়ে রাখলে গন্ধ না ছড়ায়, তার জন্য আগাম ইট, সিমেন্টও কিনে রেখে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকী, খুনের পর নিহত ব্যবসায়ীকে ভুয়ো মেল পাঠিয়েছিলেন অনির্বাণ। আবার মৃতের মোবাইল থেকে সেই মেলের উত্তর দিয়ে নিজের পালানোর রাস্তাও পরিষ্কার করে রেখেছিলেন। বালিগঞ্জ থানার পুলিশ পর পর দুবার তাঁকে ডেকে জেরা করলেও ঠান্ডা মাথায় পুলিশের প্রশ্নের সব উত্তর দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রক্তমাখা ব্যাট-উইকেট ও রাস্তার টয়লেটে ফেলে দেওয়া মোবাইলের সূত্র ধরেই বালিগঞ্জ থানার পুলিশের হাতে মঙ্গলবার ধরা পড়েছিলেন ভবানীপুরের ব্যবসায়ী খুনের অভিযুক্তরা।
ওষুধ ব্যবসার জন্য খুনের মাস্টারমাইন্ড অনির্বাণ গুপ্ত ও ব্যবসায়ী ভাব্য লাখানির মধ্যে ৫০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছিল। সেই জন্যই কি এই খুন, নাকি এর পিছনে প্রতিশোধ তোলার ‘মোটিভ’রয়েছে, তা জানার চেষ্টা করছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। যেভাবে প্রচণ্ড আঘাত করে ভাব্যকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে, তাতে সেই প্রশ্নই উঠে আসছে। জানা গিয়েছে, পরিকল্পনা করেই অনির্বাণ একই সঙ্গে সোমবার দুপুর বারোটা নাগাদ তার সঙ্গী সুমন দাস ও ব্যবসায়ীকে ডেকেছিলেন। তার আগে খুনের জন্য নতুন দুটি ব্যাট ও তিনটি উইকেট এনে রেখেছিলেন।
সোমবার ভাব্য লাখানি উত্তর শহরতলির নিমতার প্রবোধ মিত্র লেনে অনির্বাণের বাড়িতে ৫০ লাখ টাকা পাওনার ব্যাপারে কথা বলতে যান। সেসময় সুমন দাস বরানগর মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষ করছিলেন। কথা বলার মধ্যেই ভাব্যকে খুন করার পর সুমনকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন অনির্বাণ। সুমনের সাহায্যেই ট্যাঙ্কের নিচে নীল বস্তার মধ্যে দেহটি রেখে সেটি ইট, সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়। ইট গাঁথনির কাজে আরও কেউ সাহায্য করেছিল কি না, পুলিশ তা জানার চেষ্টা করছে। এই কাজের জন্য ক্যাটারিং কর্মী সুমনকে দুহাজার টাকাও দেওয়া হয়েছিল বলে খবর। খুনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা ব্যাট ও উইকেটগুলো প্রতিবেশী কিশোরদের দিয়ে দিয়েছিলেন অনির্বাণ।
এর পরই একটি ভুয়ো মেল থেকে ভাব্যকে মেল পাঠিয়ে অনির্বাণ জানান, ৫০ লাখ টাকার ব্যাপারে যে দেনাপাওনা ছিল, তা মিটে গিয়েছে। অনির্বাণের মেল ‘হ্যাক’ করে সেই মেলের ইতিবাচক উত্তরও দেওয়া হয়। এর মধ্যেই ভাব্যর মোবাইলে স্ত্রীর ফোন এলে তা কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়ে জানানো হয়, ?ব্যস্ত আছি।? তার পর পরিকল্পনা মতো উত্তর কলকাতার জোড়াবাগানের বাসিন্দা সুমন বড়তলার একটি টয়লেটে ভাব্যর আইফোনটি ফেলে রেখে আসেন সুমন। কিছুক্ষণ পর এলাকার এক বাসিন্দা সেটি কুড়িয়ে পান। সেই ব্যক্তিকে জেরা করে ও অনির্বাণের কল লিস্টে সুমনের নম্বরের সূত্র ধরে সন্দেহের বশেই সুমনকে আটক করা হয়। পুলিশ তাঁকে বালিগঞ্জ থানায় নিয়ে আসতেই আধিকারিকদের ঘরে অনির্বাণকে দেখে চমকে যান সুমন। মঙ্গলবার রাতে দুজনকে মুখোমুখি জেরা করতেই ভেঙে পড়েন দুজনে।
জেরায় অনির্বাণ পুলিশকে জানিয়েছেন, নিমতার বাড়ির একতলায় তিনি ও তাঁর স্ত্রী ভাড়া থাকতেন। স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা। সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ ভাব্যকে খুন ও দেহ সরানোর সময় স্ত্রী বাড়িতে না থাকার ফলে তাঁর কাজের সুবিধা হয়েছিল। মঙ্গলবার গভীর রাতে অনির্বাণকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ তাঁর বাড়িতে যায়। বাড়ির ছাদের ট্যাঙ্কের তলায় নতুন ইটের গাঁথনি ভেঙে ভাব্যর দেহটি পুলিশ উদ্ধার করা হয়। বুধবার এই ঘটনা জানাজানি হতেই ব্যাট ও উইকেটগুলো পরীক্ষা করে পাড়ার ছেলেরা দেখে, তাতে রক্ত লেগে রয়েছে। তাদের কাছ থেকেই পুলিশ খুনের এই অস্ত্রগুলো উদ্ধার করেছে। সেগুলোকে ফরেনসিকে পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।