• মধ্যরাতে বহুতল ভেঙে পড়ল, অন্তত ৯ জনের প্রাণ গেল! খাস কলকাতায় প্রশ্ন উঠল, এমন আরও আছে?
    আনন্দবাজার | ১৯ মার্চ ২০২৪
  • নির্মীয়মাণ একটি বহুতল রবিবার রাত ১২টা নাগাদ ভেঙে পড়ে। ভগ্নস্তূপে চাপা পড়ে গুঁড়িয়ে গিয়েছে
    আশপাশের কয়েকটি ঝুপড়ি। কলকাতার গার্ডেনরিচ এলাকার এই বিপর্যয়ে সোমবার রাত পর্যন্ত
    মারা গিয়েছেন ন’জন। পুলিশ গ্রেফতার করেছে প্রোমোটারকে। এ সবের মধ্যেই উঠছে অসংখ্য প্রশ্ন। দায় কি শুধুই প্রোমোটারের? পুরসভা
    এবং প্রশাসনের ‘নাকের ডগায়’ কী ভাবে গজিয়ে উঠল এই বহুতল? কার অনুমতিতে? শহরে কি
    এমন বহুতল আরও রয়েছে?

    কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম মেনে নিয়েছেন, ওই বহুতল বেআইনি
    ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। বেআইনি নির্মাণের
    কথা শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও। তিনি ঘটনাস্থল
    পরিদর্শনের পর জানান, প্রোমোটারদের
    একাংশ বেআইনি ভাবে বাড়ি তৈরি করেন। তিনি এ-ও জানান, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এই
    বহুতলটি তৈরি করা হয়নি। মেয়র এ বিষয়ে আঙুল তুলেছেন পূর্বতন বাম সরকারের দিকেই। তাঁর অভিযোগ, সেই সময় থেকেই এ সব এলাকায় বেআইনি ভাবে বাড়ি তৈরি
    হচ্ছে।

    বহুতল নির্মাণ যে অনুমতি
    ছাড়াই শুরু হয়েছিল, পুলিশি জেরায় তা স্বীকার করে নিয়েছেন ধৃত প্রোমোটার মহম্মদ
    ওয়াসিম। তিনি জানান, অনুমতি মিলবে না বুঝেই কাজ শুরু করেছিলেন। শুধু সেখানেই শেষ
    নয়। বাড়ি যাঁর জমিতে, তিনি দ্রুত ফ্ল্যাট চেয়েছিলেন। সেই কারণে বহুতলের নীচের অংশ
    নির্মাণের আগেই উপরের অংশের নির্মাণ শুরু করা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠছে, নির্মাণের
    অনুমতি কেন মেলেনি? সেই প্রশ্নের জবাব মিলেছে পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের একটি সূত্র
    থেকে। তাদের দাবি, বাড়ির ভিতের ধারণ ক্ষমতা দোতলার বেশি
    ছিল না। এই কারণে বরো অফিসে বাড়িটির উপর আরও তলা সংযোজনের অনুমতি নিতে গেলে তা
    খারিজ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও প্রকাশ্যে দোতলা বাড়ির উপরে বেআইনি ভাবে
    আরও তল বৃদ্ধি করা হয়। পুরসভার একটি অংশ মনে করছে, বাড়ির ভিত চারতলার ভার
    বহন করতে পারেনি। তাতেই ঘটেছে এই বিপর্যয়।

    কিন্তু সকলের চোখের সামনে কী
    করে পাঁচ তলা উঠে গেল? কোনও অনুমতি ছাড়াই? প্রশ্ন তুলেছেন খোদ মেয়রই। তিনি বলেছেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণের শুরুতেই ধরব। বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে, মানুষ সেখানে থাকতে শুরু করলে মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এ
    সব কেন হবে? শুরুতেই আটকে দিলে তো এ সব ঘটে না।’’

    প্রশ্ন উঠেছে, তা করা হল না
    কেন? তা হলে কি কাউন্সিলর দায়ী? ফিরহাদ স্পষ্ট জানিয়েছেন, এ জন্য কাউন্সিলর দায়ী
    নন। কারণ গলির ভিতর কী হচ্ছে, তা দেখা সম্ভব নয়। তিন
    ইঞ্জিনিয়ারকে শো কজ় করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

    তাতে যদিও বিরোধীরা থামছে না।
    রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রশ্ন তুলেছেন ফিরহাদের ভূমিকা নিয়ে। বিজেপি নেতা রাকেশ সিংহ সোমবার নথি দেখিয়ে দাবি করেছেন, তিনি দু’বছর আগে
    রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত স্তরে জানিয়েছিলেন, কলকাতার আটটি এলাকায় ‘বেআইনি’ বহুতল
    নির্মাণ চলছে। পাল্টা জবাব দিয়েছে শাসকদলও। তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক
    বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই
    সব বিষয় রুখতে পুরসভা, প্রশাসন এবং আদালতের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি। খাস কলকাতায় এই বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছুই কি দেখিয়ে
    দিল না! তাতে কি সজাগ হবে প্রশাসন? ভবিষ্যতে বিপর্যয় কি রোখা যাবে? না কি এ ভাবেই
    চলবে বেআইনি নির্মাণ?

    মধ্যরাতে যা হয়েছিল

    রবিবার রাত ১২টা নাগাদ
    গার্ডেনরিচের ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়ে পাশের ঝুপড়ির উপর।
    বেশ কয়েকটি টালির চালের বাড়ি গুঁড়িয়ে যায়। এই সোমবার রাত পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ৯
    জন। সোমবার সকালে প্রথমে দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। তাঁদের উদ্ধার করে
    স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা দু’জনকে মৃত বলে ঘোষণা
    করেন। পরে আরও চার জনকে উদ্ধার করে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা
    তাঁদেরও মৃত বলে ঘোষণা করেন। প্রশাসন সূত্রে সাত জনের নাম জানা গিয়েছে— শামা বেগম
    (৪৪), হাসিনা খাতুন (৫৫), রিজওয়ান আলম (২২), আকবর আলি (৩৪), মহম্মদ
    ওয়াসিক, মহম্মদ ইমরান এবং রমজান আলি। এই ঘটনায়
    অভিযুক্ত প্রোমোটারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর নাম মহম্মদ ওয়াসিম। প্রশাসন সূত্রে
    পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গার্ডেনরিচের ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২ জন। তাঁদের
    উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এসএসকেএমে ভর্তি রয়েছেন তিন জন। গার্ডেনরিচে
    ভর্তি রয়েছেন ৯ জন। পাঁচ জনকে চিকিৎসার পর এসএসকেএম থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা
    হলেন, জাহারা বেগম, মহম্মদ আসলাম, শাহিনা খাতুন এবং নুর
    সালিম ইসলাম। এক জনের নাম জানা যায়নি। আহতদের মধ্যে রয়েছে তিন শিশুও।

    সকালেই পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী

    ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন
    মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিছু দিন আগে নিজের বাড়িতে পড়ে গিয়ে কপালে চোট
    পেয়েছেন তিনি। চিকিৎসকেরা তাঁকে ১০ দিন বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কপালে
    ব্যান্ডেজ নিয়েই সোমবার সকালে গার্ডেনরিচে যান মমতা। এলাকা ঘুরে দেখেন এবং
    হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গে কথা বলেন। শোক প্রকাশ করে দোষীদের শাস্তির আশ্বাসও
    দেন মমতা। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর তিনি বলেন, ‘‘এটা খুব
    ঘিঞ্জি এলাকা। মন্ত্রীরা সারা রাত এখানে ছিলেন। প্রোমোটারদের একাংশ বেআইনি ভাবে
    বাড়ি তৈরি করেন। তার আগে ভাবা দরকার, আশপাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের যাতে ক্ষতি না
    হয়। আমি শুনলাম, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এই বহুতলটি তৈরি করা হয়নি। এখন রমজান মাস
    চলছে। সকলে উপোস করে থাকেন। তা-ও সারা রাত এলাকার মানুষ উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছেন।
    স্বাস্থ্য দফতর, দমকল, পুলিশ, কাউন্সিলরেরা সারা রাত ধরে কাজ করেছেন।’’ রবিবার রাতেই
    ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন মেয়র। ঘটনাচক্রে, তিনি ওই এলাকার বিধায়কও।
    দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুও ঘটনাস্থলে যান। ওঁরা সারা রাত এলাকায় ছিলেন। ফিরহাদ জানান, সরকারের
    তরফে মৃতদের পরিবার পিছু পাঁচ লক্ষ টাকা এবং আহতদের এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া
    হবে। গার্ডেনরিচে গিয়েছেন কলকাতা দক্ষিণের সাংসদ মালা রায়। ছিলেন কলকাতার পুলিশ
    কমিশনার বিনীত গোয়েল।

    বেআইনি, মানলেন ফিরহাদ

    বহুতলটি যে বেআইনি ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন
    ফিরহাদ। সেই সঙ্গে তিনি
    জানিয়েছেন, ওই এলাকায় বাম আমল থেকে বেআইনি নির্মাণ চলছে। ফিরহাদ এ প্রসঙ্গে
    বলেন, ‘‘এ সব এলাকায় বাম আমল থেকে বেআইনি নির্মাণ চলছে। কারণ, সে সময়ে
    প্রশাসনের কাছ থেকে নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যেত না। অনুমতি জোগাড় করতে অনেক
    হেনস্থার শিকার হতে হত। বিএলআরও অফিসে গিয়ে পায়ের চটি ক্ষয়ে যেত। তাই প্রোমোটারেরা
    বেআইনি নির্মাণের পথে হাঁটতেন। আমরা আসার পর এই কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছি। তা-ও কেন
    কিছু কিছু লোক বেআইনি নির্মাণ করছেন, জানি না।’’ ওই বহুতলের প্রোমোটারকে অবিলম্বে
    গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন মেয়র। মৃতদের পরিবারকে পাঁচ
    লক্ষ এবং আহতদের এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রশাসনের
    নজর এড়িয়ে কী ভাবে বেআইনি নির্মাণ চলছে? এ বিষয়ে স্থানীয়
    কাউন্সিলরকে দোষ দিতে রাজি হননি ফিরহাদ। তিনি বলেন, ‘‘কোন গলিতে বেআইনি ভাবে
    কী তৈরি হচ্ছে, সেটা কাউন্সিলর জানবেন কী ভাবে? এটা দেখা তাঁর কাজ নয়।
    আধিকারিকদের কাজ। নিঃসন্দেহে প্রশাসনকে আরও কড়া হতে হবে। আমরা
    আইনি ব্যবস্থা নেব। আপাতত যাঁরা ভিতরে আটকে আছেন, তাঁদের উদ্ধার করা
    আমাদের অগ্রাধিকার।’’

    স্বতঃপ্রণোদিত মামলা পুলিশের

    গার্ডেনরিচে বিপর্যয়ের ঘটনায়
    প্রোমোটার ও অন্য জড়িতদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে (সুয়ো মোটো) মামলা দায়ের
    করল কলকাতা পুলিশ। কলকাতা পুরসভাও শো কজ় করেছে তিন ইঞ্জিনিয়ারকে। এ কথা জানিয়েছেন
    মেয়র। ফিরহাদ জানিয়েছেন, ওই বরোর এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাসিস্ট্যান্ট
    ইঞ্জিনিয়ার এবং সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে শো কজ় করা হয়েছে। পুরসভা সূত্রে
    খবর, আগামী
    ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অবস্থান জানাতে বলা হয়েছে তাঁদের। সময়ের মধ্যে তাঁরা যদি
    সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারেন, তা হলে তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হতে পারে
    বলে খবর পুরসভা সূত্রে। কোন ওয়ার্ডে কত বেআইনি বাড়ি আছে, তা চিহ্নিত করাও তাঁদের
    দায়িত্ব ছিল। সেই কাজে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। দায়িত্ব পালন করেননি। ফিরহাদ বলেন, ‘‘বাড়িটা উঠল
    কী করে? আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি। টক টু মেয়রেও বলেছি। বেআইনি
    নির্মাণের শুরুতেই ধরব। বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে, মানুষ সেখানে থাকতে শুরু
    করলে মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এ সব কেন হবে? শুরুতেই আটকে দিলে তো এ সব ঘটে না।’’ যদিও তিন
    আধিকারিক তাঁদের ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেছেন যে, বাড়িটা অনেক ভিতরে ছিল।
    সেই কারণে তাঁদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে।

    অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ

    পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেরায় প্রোমোটার
    স্বীকার করে নিয়েছেন, অনুমতি ছাড়াই বহুতল নির্মাণ শুরু করিয়েছিলেন তিনি।
    বুঝেছিলেন অনুমতি মিলবে না। তাই ওই কাজ করেছিলেন। পুলিশ সূত্রে জানা
    গিয়েছে, প্রোমোটার জেরায় জানিয়েছেন, যাঁর জমিতে তৈরি হচ্ছিল
    ওই বহুতল, তিনি ফ্ল্যাটের জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন। সেই কারণে ফ্ল্যাটের
    নীচের তলা তৈরির আগেই উপর তলার কাজ শুরু করে দেওয়া হয়। গ্যারাজের উপর চারটি তলা
    ছিল। মোট ১৬টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হচ্ছিল সেখানে। অর্থাৎ এক-এক তলায় চারটি করে।
    প্রতি বর্গফুটের দাম ১,৬০০ টাকা। স্থানীয় সূত্রে খবর, যেখানে
    দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে সাত-আট বছরের পুরনো একটি দোতলা বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির
    উপরে আরও দুই থেকে তিন তলা তোলার চেষ্টা করেন বাড়ির মালিক এবং প্রোমোটার। পুরসভার
    বিল্ডিং বিভাগের একটি সূত্রের অভিযোগ, বাড়ির ভিতের ধারণ ক্ষমতা দোতলার বেশি ছিল না। এই
    কারণে বরো অফিসে বাড়িটির উপর আরও তল সংযোজনের অনুমতি নিতে গেলে তা খারিজ করে
    দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও প্রকাশ্যে দোতলা বাড়ির উপরে বেআইনি ভাবে আরও তল
    বৃদ্ধি করা হয়। পুরসভার একটি অংশ মনে করছে, বাড়ির ভিত চারতলার ভার
    বহন করতে পারেনি। তাতেই ঘটে এই বিপর্যয়। পুরসভার একটি অংশের আরও দাবি, ওই এলাকায়
    বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করা ঝক্কির বিষয়। পুলিশের সহযোগিতা মেলে না। স্থানীয়েরা বাধা
    হয়ে দাঁড়ান। আক্রান্ত হতে হয় পুরকর্মীদের।

    কর্তব্যে অবিচল
    উদ্ধারকারীরা

    রাত থেকেই কাজে নেমে পড়েন
    পুরসভা, রাজ্য সরকারের অসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মীরা। ঘন অন্ধকার।
    তার মধ্যে ধসে পড়েছে আস্ত বহুতল। ভিতরে কী রয়েছে, প্রথমটায় কিছু দেখতেই
    পাচ্ছিলেন না কর্মীরা। শুধু ভেসে আসছিল গোঙানির শব্দ। এবং আর্তনাদ। ভগ্নস্তূপে
    আটকে পড়া অনেকেই তখন দিশেহারা। এক ব্যক্তি উদ্ধারকারীদের কাছে জল খেতে চান। সঙ্গে
    সঙ্গে বোতলে ভরে তাঁর কাছে জল পাঠানো হয়। এর পর তিনি চিৎকার করে জানান, শ্বাসকষ্ট
    হচ্ছে। পাঁচ তলা বাড়ি ধসে গিয়েছে। এক-একটি তলের উচ্চতা কমে হয়ে গিয়েছে তিন থেকে
    চার ফুট। তার মধ্যে মানুষ সোজা হয়ে হাঁটতে না পারলেও শ্বাসকষ্ট হওয়ার কথা নয়।
    কর্মীরা বুঝতে পারেন, উৎকণ্ঠার কারণেই শ্বাসকষ্ট বোধ হচ্ছে ওই ব্যক্তির। সঙ্গে সঙ্গে
    তাঁকে অক্সিজেন সরবরাহ করেন। তার পর তাঁর উদ্বেগ কমানোর জন্য কথাবার্তাও বলে যান
    উদ্ধারকারীরা। কারণ তখনও তাঁকে বার করে আনার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তড়িঘড়ি তা
    করতে গেলে আরও বড় বিপদ হতে পারত। ভেঙে পড়তে পারত বহুতলের বাকি অংশও। পাঁচ তলা
    বাড়ির ভগ্নস্তূপ থেকে উদ্ধার বা এই জল, অক্সিজেন জোগানের কাজ কিন্তু খুব সহজ নয়। অসামরিক
    প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মীদের তরফে জানানো হয়েছে, বহুতলের উপরের তলগুলির
    ছাদে ক্রমে ক্রমে দু’ফুট বাই দু’ফুট চৌকো অংশ কেটে প্রবেশ পথ তৈরি হচ্ছে। উপর থেকে
    সেই ফাঁক গলেই ক্রমে নীচের দিকে নামার চেষ্টা চলছে।

    বিরোধীদের তোপ

    এই ঘটনায় মেয়র ফিরহাদকে
    কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। সোমবার এক্স
    (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে তিনি গার্ডেনরিচের ঘটনা নিয়ে চারটি প্রশ্ন
    তুলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম পুরমন্ত্রী ফিরহাদের ভূমিকা। গার্ডেনরিচের ঘটনা নিয়ে
    রাতেই পোস্ট করেছিলেন শুভেন্দু। সোমবার সকালে আরও একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘‘গার্ডেনরিচে
    পাঁচ তলা বাড়ি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা বাসিন্দাদের
    উদ্ধার এবং আহতদের চিকিৎসার উপরেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কিন্তু এই ঘটনা বেশ কিছু
    প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। প্রথমত, বাম সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তৃণমূল সরকার আসার পর
    থেকে কলকাতা পুরসভা এলাকার মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি জলাজমি বেআইনি ভাবে ভরাট করা
    হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর, পুলিশ এবং তৃণমূল নেতাদের মদতেই এই বেআইনি কাজগুলি
    হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ কোনও
    ক্ষেত্রে প্রশাসনের তরফে বাধা আসেনি। বর্তমানে শুধু গার্ডেনরিচেই বেআইনি নির্মাণের
    সংখ্যা ৮০০-র বেশি। এলাকাটি ফিরহাদের ‘দুর্গ’। ওঁর এলাকায় ওঁর নাকের ডগা দিয়ে এই বেআইনি কাজ হচ্ছে আর উনি কিছু
    জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?’’ বন্দর
    এলাকার একদা কংগ্রেস এবং অধুনা বিজেপি নেতা রাকেশ সোমবার নথি দেখিয়ে দাবি করলেন, তিনি দু’বছর আগে
    রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত স্তরে জানিয়েছিলেন, কলকাতার আটটি এলাকায় ‘বেআইনি’ বহুতল
    নির্মাণ চলছে। ওই সমস্ত নির্মাণে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছর জুন মাসে
    রাকেশ চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট
    (ইডি)-এর ডিরেক্টর এবং কলকাতা জ়োনের জয়েন্ট ডিরেক্টরকে।

    অভিষেকের পাল্টা জবাব

    শুভেন্দুকে পাল্টা বার্তা দিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক
    অভিষেক। তিনি
    বলেন, ‘‘যে সব বিরোধী নেতা এত প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের বলব, রাজনীতি পরে
    করুন। এই মুহূর্তে আটকে পড়াদের কী ভাবে উদ্ধার করা হবে, সেটা নিয়ে
    আমাদের ভাবতে হবে। এই ঘটনাটা নিয়ে এখন রাজনীতি করা ঠিক হবে না। এ রকম যাতে আর না
    ঘটে, সেটাই দেখতে হবে আমাদের। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই তা নিশ্চিত করতে হবে।’’ সোমবার দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে কলকাতা
    বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে তিনি এ-ও বলেন, ‘‘এই ধরনের ঘটনা রুখতে পুরসভা, প্রশাসন
    এবং আদালতের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি।’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)