Garden Reach Building Collapsed : ‘আমরাও বিল্ডিং চাপা পড়ে মরব না তো?’, আতঙ্কপুরি গার্ডেনরিচ!
এই সময় | ২০ মার্চ ২০২৪
এই সময়: গার্ডেনরিচ যেন বেআইনি বাড়ির ওপেন মার্কেট! কেউ সেখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন ৫০ লাখে, কেউ বা ৩০ লাখে। প্রোমোটারদের কাছ থেকে সেই ফ্ল্যাট যখন ক্রেতা পেয়েছেন, ততদিনে ওই বহুতল বেআইনি নির্মাণের তকমা পেয়ে গিয়েছে। জি প্লাস থ্রি-র অনুমোদন থাকলেও, তার বদলে মাথা তুলেছে ছ’তলা বহুতল। প্রতিবাদ যে হয়নি, তা কিন্তু নয়। তবে সেই কণ্ঠস্বর এতদিন পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার বা পুলিশকর্মীদের কানে পৌঁছয়নি বলেই অভিযোগ।রবিবার মধ্যরাতে গার্ডেনরিচের আজহুড় মোল্লা বাগান লেনের বহুতল বিপর্যয়ে মৃত্যু মিছিলের পরে স্থানীয় কাউন্সিলার শামস ইকবাল এবং বিধায়ক ফিরহাদ হাকিমকে দায়ী করছেন এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ। পুরো বিষয়টি নিয়ে কলকাতা পুরসভার উপরে যে রীতিমতো চাপ বাড়ছে, তা স্পষ্ট হয়েছে মহানাগরিকের বক্তব্যেই। মঙ্গলবার ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘এই ঘটনায় কারও গাফিলতি থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুরসভার কেউ জড়িত থাকলেও ছাড় পাবে না।’
ঘটনাচক্রে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুরসভার চারজন ইঞ্জিনিয়ারকে বদলিও করা হয়েছে। তবে ধ্বংসস্তূপ থেকে সবাইকে উদ্ধার করা গিয়েছে, তা বলার সময় এখনও আসেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ। সোমবার রাতে এনডিআরএফ এবং কলকাতা পুলিশের ডিএমজি টিম আরও একজনের দেহ উদ্ধার করে। মৃতের নাম মহম্মদ জামিল (৪০)। এনিয়ে বাড়ি ধসে পড়ার ঘটনায় মোট দশ জনের মৃত্যু হলো। মঙ্গলবার রাতে বিতর্কিত ওই জমির মালিক মহম্মদ সরফরাজকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে খুন এবং খুনের চেষ্টার মতো ধারাও যুক্ত করা হয়েছে।
এক আঙুলের দূরত্বে দুই বহুতল!
আজহুড় মোল্লা বাগানের যেখানে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়েছে, তার ঠিক আশপাশে মাথা তুলেছে আরও একাধিক বেআইনি বাড়ি। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকশো মিটার দূরে পর পর দু’টি বহুতল বিপজ্জনক ভাবে একে অন্যের উপর যেন ঝুঁকে রয়েছে। দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চির! ছ’তলার দু’টি বহুতলে ৩০টি পরিবারের বাস। যখন বহুতল তৈরি হচ্ছিল, তখনও বোঝা যায়নি বছর পাঁচেকের মধ্যে তা বেআইনি হয়ে যাবে। মামলা হওয়ায় পুরসভার তরফে বিপজ্জনক বাড়ির স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়েছে। তবে আর কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।
এরকমই একটি বহুতলের বাসিন্দা রাজীব রায়ের আক্ষেপ, ‘পুলিশ-পুরসভাকে বলেও কাজ হয়নি। প্রোমোটার ঘুরছেন এলাকায়। মৃত্যু হলে তখন আবার প্রশাসন নড়েচড়ে বসবে।’ একই সুর নীলাঞ্জন আগরওয়ালের। ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, ‘প্রোমোটার কাউন্সিলারের ঘনিষ্ঠ। কী আর করব?’ গার্ডেনরিচ থানা এলাকার প্রধান রাস্তা পাহাড়পুর রোডেও এমন ছবি ধরা পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, ‘গার্ডেনরিচের প্রতিটি রাস্তায়, অলিগলিতে এমন বেআইনি বহুতল মুড়িমুড়কির মতো গজিয়ে উঠেছে। তা পুলিশ আর পুরসভা জানে না?’ এলাকাবাসীর প্রশ্ন, ‘আমরাও বিল্ডিং চাপা পড়ে মরব না তো?’
জালে ওয়াসিম, নজরে অনেকেই
বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিমকে গ্রেপ্তার করা হলেও আরও বেশ কয়েকজন পুলিশের নজরে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে পুরসভার আধিকারিকদের একাংশওও রয়েছেন বলে সূত্রের খবর। এদিন আদালতে সওয়াল-জবাবে সরকারি আইনজীবী বলেন, ‘২০১৩ সালে পুনেতে একই রকম ঘটনায় ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তাতে পুরসভার আধিকারিক-ইঞ্জিনিয়াররা গ্রেপ্তার হন। গার্ডেনরিচের ঘটনায় প্রোমোটারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও অনেকের গাফিলতি থাকতে পারে।’
ওয়াসিমকে ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে চাওয়া হলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। আদালতে ঢোকার সময়ে সাংবাদিকরা বেআইনি নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন করলে ওয়াসিম বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার সব জানত।’ এদিনই আবার ধৃতের সঙ্গে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলার শামস ইকবালের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা তোপ দেগেছেন শাসক দলের ওই নেতার বিরুদ্ধে। পুলিশ সূত্রে খবর, গার্ডেনরিচের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত চাপা পড়া ২৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে। মৃতের তালিকায় দশ নম্বরে থাকা মহম্মদ জামিল একটি বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে ওই বহুতলে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সে সময়ে তিনি চাপা পড়েন।
১ বছর ৮০০ বেআইনি নির্মাণ ধুলিসাৎ
বেআইনি নির্মাণ নিয়ে অভিযোগ উঠলেও বিল্ডিং বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত তিন বছরে ১৬টি বরোতে ৮৬৩টি বেআইনি নির্মাণ ভাঙা হয়েছে। যার মধ্যে ২০২৩ থেকে ’২৪ সালে ৮০০টি নির্মাণ ভাঙা হয়। বিল্ডিং বিভাগের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘অবৈধ নির্মাণ ভাঙা হয় পুরসভার বিল্ডিং আইনের ৪০১ নম্বর এবং ৪০৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী। পুরসভা এজন্য একটি টিমও গঠন করেছে। যে দলে পুরসভার ১৬টি বরোর বিল্ডিং বিভাগের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার এবং দু’জন করে সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। এদিনও বেনিয়াপুকুর এলাকায় দু’টো বেআইনি নির্মাণ ভেঙেছে।’
অন্যদিকে, গার্ডেনরিচের ঘটনায় এ বার পুরসভার তরফে প্রোমোটার ওয়াসিম ছাড়ও তাঁর দুই সহযোগী মহম্মদ নাসিম এবং রাজার বিরুদ্ধে গার্ডেনরিচ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, ওই বহুতলের জন্য কোনও অনুমতি না নিয়ে তিন কাঠা জমির উপরে ‘জি প্লাস থ্রি’ বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছিল।