Spring Season : বসন্ত চুরি, শীতের পরেই গ্রীষ্ম, দুশ্চিন্তায় পরিবেশবিদরা
এই সময় | ২০ মার্চ ২০২৪
এই সময়: সেই কবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে’...। তার পর পেরিয়েছে কতগুলো বছর। গীতিকার পুলকবাবু নেই। এবং গানটাও যেন প্রায় অর্থহীন হতে চলেছে। কারণ, বসন্ত এখন নাকি ঠিক মতো আসেই না!শোনা যায়, অতীতে নাকি সবই ভালো ছিল। শীতের সময়ে ঠান্ডাটাও জমিয়ে পড়ত আর শীত চলে গেলে দোল পর্যন্ত গা শিরশিরানি অনুভূতিটাও থেকে যেত। গরম পড়তেই এখন পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের থেকে এমন হা-হুতাশ এখন নিয়মিত শোনা যায়। অতীতের সেই যেতে গিয়েও থমকে থাকা শীত আর পড়ি পড়ি করেও না-পড়া গরম নিয়ে ওঁদের নস্ট্যালজিয়ার শেষ নেই।
সোজা কথায়, ছোটবেলায় যে ছ’টা ঋতুর কথা শেখানো হয়, তার শেষটি অর্থাৎ বসন্ত যে রয়েছে শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যে, সেটা দিব্যি অনুভব করতে পারতেন তখনকার মানুষজন। পারতেন বলেই তো বসন্তকাল নিয়ে অজস্র কবিতা এবং গান এই বাংলাতেই। বসন্ত নিয়ে রোম্যান্টিকতারও শেষ নেই। কিন্তু এখন কি বসন্তকাল তার অতীত গৌরব সত্যিই হারিয়েছে? ব্যাপারটা ঠিকঠাক জানতে ও বুঝতে ১৯৭০ থেকে ২০২৩— মোট ৫৪ বছরের ডেটা সংগ্রহ করে গবেষণা চালান আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে কর্মরত সংস্থা ক্লাইমেট সেন্ট্রালের আবহবিদরা। সেই গবেষণার ফলই এ বার সামনে এসেছে। এবং সেখানে আবহবিদরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এ দেশে বসন্ত এখন সত্যিই এক লুপ্তপ্রায় ঋতু!
পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজির গবেষকরা ক্লাইমেট সেন্ট্রালের গবেষণায় পাওয়া তথ্যের ব্যখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন, ‘অতীতে শীতের শেষে তাপমাত্রা ক্রমশ কমত। সেই অনুপাতে গরম বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটা চলত প্রায় এক-দেড় মাস ধরে। এই কারণেই একটা আরামদায়ক অনুভূতি থেকে যেত শীত চলে যাওয়ার পরে এবং প্রচণ্ড গরম পড়ার আগে। সেটাই বসন্তকাল। কিন্তু গত কয়েক বছরে তাপমাত্রার ওই ক্রমপরিবর্তনটা আর হচ্ছে না। শীতের আবহ পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ৮-১০ দিনের মধ্যেই।’
শুধু শীতের পরের ঋতু বসন্ত নয়, শীতের ঠিক আগের হেমন্তকালও একই ভাবে অস্তিত্বের সঙ্কটে। দু’দশক আগেও দুর্গাপুজো পার হয়ে কালীপুজোর মুখে গায়ে হাফ সোয়েটার চড়াতে হতো কলকাতা শহরেই। শহরতলিতে কালীপুজোর সময়ে থাকত রীতিমতো ঠান্ডা। সেই জায়গায় এখন শীতকালের অধিকাংশ দিনেই গায়ে লেপ দেওয়ার দরকার হয় না কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায়। বড়জোর কম্বলেই কাজ মিটে যায়। আবার মার্চে এসি চলতে শুরু করে, এমন বাড়ির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শীত ও গ্রীষ্মের মাঝখানে যে ঋতুর থাকার কথা, সেই বসন্তকাল তা হলে কোথায় গেল?
‘হারিয়ে যাওয়া’ সেই বসন্তকে খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে ক্লাইমেট সেন্ট্রালের আবহবিদদের গবেষণায় ধরা পড়েছে, কী ভাবে ১৯৭০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শীতের প্রাবল্য কমেছে। শীত কমে যাওয়ার কারণেই জানুয়ারির শেষ থেকে আস্তে আস্তে শুরু হয় গরমের প্রভাব। ক্লাইমেট সেন্ট্রালের বিজ্ঞান বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু পারসিং বলছেন, ‘ভারতকে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এবং মধ্য— এতগুলো ভাগে ভাগ করে আমরা প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকের ডেটা বিশ্লেষণ করে কাজ শুরু করেছিলাম। আমরা দেখেছি, প্রধানত মধ্য ভারতে এবং উত্তর ভারতে কিছু কিছু জায়গায় শীতের তাপমাত্রা কমার হার কমেছে। এর পাশাপাশি, ওই জায়গাগুলোয় ফেব্রুয়ারি থেকেই তাপমাত্রা বাড়ার হার বেশ চড়া। এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবে শীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গরম পড়ে যাচ্ছে। বসন্তের অনুভূতি নেই বললেই চলে।’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পুনর্বসু চৌধুরী বলছেন, ‘হেমন্ত ও বসন্ত কাল অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। ভারতের মতো দেশে যেখানে ঋতুবৈচিত্র খুব স্পষ্ট ছিল, সেখানে আস্ত একটা ঋতু গায়েব হওয়া খুব বিপজ্জনক লক্ষণ।’ ‘হংসরাজ’ ছবিতে গানের মাধ্যমে আর্তি জানায় কলকাতায় এসে পৌঁছনো বাউল হংসরাজ, দাদা বসন্তকে সে ডেকে দিতে বলে। কিন্তু বসন্তই যদি না-থাকে, ডেকে দিলে বললেও কি কোনও লাভ আছে আর!