সৌমিত দেব : কোনও একটি দুর্ঘটনা ঘটলে, সেটি ঝড়-বাদল বা ভূমিকম্প বা বাড়ি ধসে পড়া বা নৃত্যশিল্পী / অভিনেত্রীর শাড়ির আঁচল সংক্রান্ত মন্তব্য, যা-ই হোক না কেন, বেশ কিছু মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ‘সেফ’ মার্ক করে। অর্থাৎ উক্ত দুর্ঘটনায় তারা কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। সুস্থ স্বাভাবিক ভালো আছেন।এই সেফ মার্ক করার বিষয়টা যদিও আজকের নয়। এর একটা দারুণ ইতিহাস রয়েছে। প্রথম যখন ‘মার্কড সেফ’ বিষয়টা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে, তখন বাকি আর সমস্ত কিছুর মতোই আমাদের ও-জিনিসটি বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। প্রথমে আমরা ভেবেছি, ওটি বোধহয় নেসেসিটি। না করলে প্রোফাইল হ্যাক হয়ে যায়।
। বা টাঙ্গাইনিকায় নেকড়ে বেরিয়েছে শুনলে টিটানগরের মানুষ নিজেদের মার্কড সেফ করতেন। কিন্তু সমস্ত আমজ়াদ খানেরই একটি করে অমিতাভ বচ্চন আর সমস্ত ল্যাবামোরই একটি করে উইকিপিডিয়া থাকে। এই নিয়মেই, বর্তমানের বাংলায় যাকে বলে একটি ‘সনসনিখেস’ তথ্য বাইরে এল।
আফ্রিকাতে নেকড়ে নেই! ব্যস, যারা নিজেদের মার্কড সেফ করেছেন তাদের নিয়ে শুরু হল মজার উৎসব! সে উৎসবও চললও বেশ কিছু দিন, এবং আস্তে আস্তে মানুষ বুঝতে পারল যে, জাপানে ভূমিকম্প হওয়ার পর জলপাইগুড়িতে বসে নিজেদের মার্কড সেফ না করলে জ়াকারবার্গ বকুনি দেবে না। একমাত্র যখন কোনও দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনও ব্যক্তির সত্যিই সরাসরি যোগাযোগ থাকতে পারে, তখনই সেই দুর্ঘটনায় নিজেদের মার্কড সেফ করা উচিত।
যেমন ধরা যাক, একজন লোক তিব্বত বেড়াতে গেছে। এই বার সেখানে ইয়েতির হামলা হল, কিন্তু সে লোক বেঁচে গেল। তখন তাঁর অধিকার আছে নিজেকে মার্কড সেফ করার। অথবা আঁচল সংক্রান্ত মন্তব্যের পর সভ্যতা, শিক্ষা, রুচিবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলি নিজেদের সেফ মার্ক করেছে, ওই মন্তব্যটি যারা সমর্থন করেছেন তাদের কাছ থেকে।
কারণ বর্তমান সময় দাঁড়িয়েও একটি মেয়ের কোন পোশাক কেমন ভাবে কেমন ভাবে পরা উচিত, তা-ই নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান তাঁদের সাবান বোধ হয় সত্যিই স্লো। কিন্তু কথা সেটি নয়। কথা হল, তার পরেও কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড সুরক্ষালোভী মানুষকে সে কথা বোঝানো যাচ্ছে না। তাতে বাকিরা রেগেও যাচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছে, কিন্তু সে সব করে লাভের লাভটা কী হচ্ছে?
মানুষের তো নানাবিধ খেয়াল, নানাবিধ শখ থাকে। তাই একটি মানুষ যদি নিজেকে মার্কড সেফ করার শখ পোষেন, তাতে কার কীই বা আসবে যাবে? ক্ষতি তো নেই-ই উলটে ভেবে দেখুন, প্যালেস্টাইনে বোমা পড়লে যদি কেউ পটলডাঙায় বসে মার্কড সেফ লেখে, আর সে জিনিস আপনার চোখে পড়ে, তা হলে কী মজাটাই না আপনি পাবেন! কত কন্টেন্ট পাবেন!
লেখার মতো, বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মতো নানাবিধ মেমফুত্তি গ্যালাখ্যালা অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে! এই যদি উনি এটা না করতেন, তা হলে তো আপনি সেই একঘেঁয়ে রিলই দেখতেন। ঘোড়ার পেডিকিয়োর থেকে শুরু করে পিরামিড সাইজের কাঁকড়ার ঝোল রাঁধা পর্যন্ত। সত্যি করে বলুন তো, অন্যের বিড়ম্বনা দেখলে আপনার মন আনন্দে নেচে ওঠে না?
সত্যি করে বলুন তো, আপনি অটোয় উঠলেন... আপনার কাছে চোদ্দ টাকাই খুচরো আছে কিন্তু আপনার সহযাত্রীর কাছে একশোর নোট। এইবার সে যখন ওই নোট দেয় আর অটোচালক ফেরত হিসেবে মুখঝামটা, আনন্দ হয় না আপনার? একটি তুষ্টি ঘিরে ধরে না আপনাকে? সহযাত্রী চলে যাওয়ার পর অটোচালককে আপনি বলেন না? – কেন যে এরা খুচরো নিয়ে ওঠে না!
কেন বলেন? কারণ আপনি সহযাত্রীর চেয়ে উন্নততর স্থানে বিরাজমান। এটা জানাতেই বলেন তো? না না, আপনি না! মানে যিনি এই মুহূর্তে লেখাটি পড়ছেন তিনি এ সব করেন না। আপনি ভালো। আমি বাকিদের কথা বলছি। তো এই যে ‘যাক বাবা আমি তো ভালো আছি’, ‘যাক বাবা আমার ছেলে তো আমার কথা শোনে’ জাতীয় আরাম হয়তো অনেকে মার্কড সেফ করেও পায়।
আমার ঘরে তো বোম পড়ছে না, আমার ছেলেকে তো নিচু জাত হয়ে কেন চেয়ারে বসেছিস বলে পিটিয়ে মেরে ফেলেনি, ব্যস, মার্কড সেফ। এ সব না হলে ‘পরের ছেলে পরমানন্দ, যত উচ্ছন্নে যায় তত আনন্দ’ জাতীয় বাগধারা মার্কেটে নামত? হিট হত? না, হত না।
তাই আসুন, বুক বাজিয়ে নিজেদের মার্কড সেফ করে নিন্দুকদের বুঝিয়ে দিই, ভালো আছি। তার পরও যদি বলে, তা হলে ‘অ্যাল’ করে জিভ ভেঙিয়ে দেবেন।