• CAA News : বৈধ নাগরিক/অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, সত্য জ়ানতি পারে কে!
    এই সময় | ২৪ মার্চ ২০২৪
  • শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার : সিএএ-এর ঘোষিত উদ্দেশ্য অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের একটি অংশকে নাগরিকত্ব দেওয়া। আর এনআরসি-র উদ্দেশ্য বৈধ ভারতীয় নাগরিকদের পঞ্জী তৈরি করা। সিএএ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্যে যোগ্য হতে হলে আবেদনকারীকে বলতে হবে যে তিনি ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান বা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে অবৈধভাবে বসবাস করছেন।অন্য দিকে, আসামের এনআরসি-তে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একজন আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে থেকে ভারতে বসবাস করা একজন বৈধ ভারতীয় নাগরিক। আসাম এবং অবশিষ্ট ভারতে ভারতের নাগরিকত্বের প্রশ্নে ভিত্তিবর্ষ ভিন্ন। ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার ও আসামের আন্দোলনকারীদের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ভারতে আসা প্রতিটি মানুষ বিদেশি এবং তাদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করা হবে।

    ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে যারা ভারতে এসেছে, তারা ভারতের বৈধ নাগরিক এবং এই দু’টি পর্বের মধ্যবর্তী সময়ে আসা সমস্ত মানুষ অ-নথিভুক্ত বহিরাগত, যাদের নাম নথিভুক্ত হলে দশ বছর প্রতীক্ষার পর নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। প্রতীক্ষার এই পর্বটিতে ভোটাধিকার ছাড়া বাকি সব নাগরিক অধিকার তারা ভোগ করবে। সংবিধানের ৬ নং ধারা অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে আসা সকলে ভারতীয়।

    এই ভিত্তিবর্ষ আসাম ছাড়া ভারতের বাকি অঞ্চলের জন্যে। এর পর যারা ভারতে এসেছেন তাঁদের বৈধ নথিপত্র না থাকলে তাঁরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং ২০০৪ সালের বাজপেয়ী সরকারের আনা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী তাঁরা বা তাঁদের বংশধরেরা কখনওই নাগরিকত্বের জন্যে বিবেচিত হবেন না।

    তবে ১৯৮৭ সাল অবধি যারা ভারতে জন্ম নিয়েছে, তারা জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। আবার, ১৯৮৭ থেকে ২০০৪ অবধি যারা ভারতে জন্মেছে, তাদের পিতামাতার একজন ভারতীয় হলে তারা জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক। কিন্তু ২০০৪ সালের পর যারা জন্মেছে তাদের নাগরিকত্বের শর্ত জটিল। এদের পিতামাতার একজন ভারতীয় নাগরিক হওয়ার পাশাপাশি আর একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হলে তবেই তারা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য।

    এই জটিলতার ভয়াবহ দিক কোথায়? এই মুহূর্তে আসামে বা পশ্চিমবঙ্গে কেউ যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চূড়ান্তভাবে ঘোষিত হয়ে যায়, তবে ভারতের মাটিতে জন্ম নিলেও তার বংশধরদের কেউই ভারতের নাগরিকত্ব পাবে না। প্রশ্ন উঠবে, ভারতের নাগরিকত্ব আইন এমন জটিল কেন? এর কারণ প্রাথমিক ভাবে আসামের রাজনীতি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল অবধি আসামে হওয়া তথাকথিত বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের শেষ হয় যে, আসাম চুক্তির মাধ্যমে, তার অভিঘাতেই একের পর সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আইন জটিল হয়েছে।

    ১৯৫১ সালে জনগণনার সময়ে আসামে একটি জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি তৈরি হয়েছিল। ২০১৩ সাল থেকে ৬ বছর ধরে ১৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করে আসাম চুক্তির শর্ত এবং ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি-র নবীকরণের প্রক্রিয়া চলে যার চূড়ান্ত পর্যায়ে মোট ৩ কোটি ৩০ লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে ১৯ লক্ষ আবেদনকারীকে বাদ গিয়ে এনআরসি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়।

    এই ১৯ লক্ষ বাদ পড়া মানুষের সামনে সুযোগ রয়েছে বিদেশি নাগরিক ট্রাইবুনালে গিয়ে পুনর্বিচার চাওয়ার। সেখানে প্রত্যাখাত হলে তারা যেতে পারে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে। সব জায়গায় ব্যর্থ হলে তারা ঘোষিত হবে বিদেশি হিসেবে। এরপর কোথায় স্থান হবে তাদের? গুয়াহাটি হাইকোর্ট গত ডিসেম্বর মাসে একটি নির্দেশে বলেছে, যারা বিদেশি বলে ঘোষিত হবে ট্রাইবুনালে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। যদিও আইনত এই এনআরসি চূড়ান্ত, কিন্তু এনআরসি-র পূর্ণ তালিকা এখনও প্রকাশিত হয়নি।

    সরকারের তরফ থেকেও তাদেরকে আবেদন প্রত্যাখ্যানের তথ্য জানিয়ে রিজেকশন স্লিপ জারি করা হয়নি। রিজেকশন স্লিপ জারি না হওয়ায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের রাস্তা বন্ধ। অথচ ১৯ লক্ষ বাদ পড়া মানুষের আধার বন্ধ! এরা সরকারি বা বেসরকারি চাকরির জন্যে আবেদন করতে পারছেন না। নতুন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না। এই ১৯ লক্ষ মানুষ ছাড়াও আসামে রয়েছেন আরও ৮ লক্ষ মানুষ যাঁদের আধার আবেদন প্রক্রিয়ায় তথ্যের গরমিলের জন্যে তাঁরা আধার বঞ্চিত।

    আছেন ২ লক্ষ মানুষ যাঁদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে যথাযথ নথিপত্রের অভাবে। তাঁদের নাম সরকারি পরিভাষায় ডি-ভোটার। তাঁরা বিদেশি হিসেবে এখনও ঘোষিত না হলেও কার্যত অধিকারহীন। এ ছাড়াও রয়েছেন আরও প্রায় ১০ হাজার মানুষ যাদেরকে বিদেশি ট্রাইবুনাল রায় দিয়েছে বিদেশি হিসেবে। এই রায়গুলির বেশিরভাগই একতরফা। অভিযুক্তরা জানতেই পারেননি কবে তাঁদের বিরুদ্ধে বিদেশি নোটিশ বেরিয়েছিল।

    মজার ব্যাপার, যে ২৬ লক্ষ মানুষের আধার বন্ধ, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই নাম ভোটার তালিকায় রয়েছে। এই মানুষগুলি কি কোনও সুরাহা পেতে পারেন সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন থেকে? না। কারণ এনআরসিতে অন্তর্ভুক্তির আবেদনে তাঁরা সকলেই নিজেদেরকে আসাম চুক্তি ও ২০০৪ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী, বৈধ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দাবি করেছেন।

    সিএএ-এর সুযোগ পেতে হলে নিজেদেরকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে হলফনামা দিতে হবে তাঁদের। পরস্পর বিরোধী হলফনামা দিলে তাঁরা শাস্তি মুখে পড়বেন না এমন রক্ষা কবচ দেয়নি সিএএ। ২০১৯ থেকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এনআরসি-ছুট হিন্দুদের আশ্বস্ত করেছেন যে, সিএএ কার্যকর হলেই তাঁরা সকলে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। এখন তিনিই বলছেন অন্য কথা। বলছেন অতিরিক্ত একটি মানুষও যদি নাগরিকত্ব পায় এই আইনে, তবে তিনি পদত্যাগ করবেন।

    তিনি একইসঙ্গে দাবি করেন, এনআরসি-ছুটরা কখনওই আবেদন করবে না, কারণ তারা কখনওই নিজেদেরকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলবে না। অহমিয়া সমাজের আতঙ্কও অমূলক, কারণ সিএএ-তে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে বহিরাগত আসার সুযোগ নেই। ফলে নতুন করে ভাষা সংস্কৃতি হারানোর কোনও কারণ নেই। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু জনগণের জন্যেও এই আইন কার্যত অর্থহীন। কারণ এর জটিল প্রক্রিয়ার শর্ত পূরণ করে তাঁদের নিজেদের আবেদনকে গ্রাহ্য করানো প্রায় অসম্ভব।
  • Link to this news (এই সময়)