• বসন্তোৎসবে আর প্রাণের আরাম খুঁজে পান না প্রবীণ আশ্রমিকেরা ...
    আজকাল | ২৪ মার্চ ২০২৪
  • পল্লবী ঘোষ: সময়ের সঙ্গে রীতির খানিক পরিবর্তন ঘটে সর্বত্রই। কিন্তু রুচির পরিবর্তন বদল ঘটায় সংস্কৃতির। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব। যে উৎসব ঘিরে আপামর বাঙালির আগ্রহ আর উন্মাদনা চিরকাল। কালে কালে সেই উৎসবের আঙ্গিকে এত পরিবর্তন, যা ঘিরে বিরক্ত প্রবীণ আশ্রমিকেরা। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবকে আর "উৎসব" বলতে রাজি নন তাঁরা। প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর জানালেন, ৮ বছর বয়সে সপরিবারে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তাঁর কথায়, "১৯৪৭ সাল থেকে নিয়মিত বসন্তোৎসব দেখেছি। ছটি ঋতুকে যাতে আমরা মনের মধ্যে গ্রহণ করতে পারি, সেই জন্য উৎসবগুলি শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন জনসমাগম ছিল না। ভোরবেলায় বৈতালিকে যখন "আজি দখিন দুয়ার খোলা" গাওয়া হত, তখন মনের মধ্যে অন্যরকম ভাবের জন্ম নিত। সেটা হারিয়ে গেছে। এখনকার বসন্তোৎসবে জনারণ্যে আর প্রকৃতির স্পর্শ পাওয়া যায় না, প্রকৃতিকে অনুভব করা যায় না। এখন বসন্তোৎসব হুজুগে পরিণত হয়েছে। বৈতালিকেও কত পরিবর্তন ঘটেছে। আমার মতে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিকট সম্পর্ক আর নেই বলেই এত পরিবর্তন।"প্রবীণ আশ্রমিক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা শুভ্রা ঠাকুর ভাগ করে নিলেন অতীতের নানা অভিজ্ঞতা। শুধুমাত্র নাচ-গানকে ভালবেসে উত্তরপ্রদেশ থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। পড়াশোনা শেষে অধ্যাপনা শুরু। ১৯৫৬ সাল থেকে বসন্তোৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। অবসরের কয়েকবছর পর থেকে আর সেই উৎসবে যোগ দেন না। এখন দূর থেকেই দেখেন। তাঁর বক্তব্য, "এখনকার নাচে আগের মতো আবেদন খুঁজে পাই না। কেউ আর প্রাণ ঢেলে নাচে না। এখন সাজেরও কত পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের সময়ে দোকান থেকে হলুদ শাড়ি কিনে পরার চল ছিল না। জলে পলাশ ফুল মিশিয়ে, সেই হলুদ রঙেই সাদা শাড়ি রাঙানো হত। ইস্ত্রি ছিল না। তাই শাড়ি টানটান করে তোষকের তলায় রেখে দিতাম। সেই শাড়ি পরেই বসন্তোৎসবের সকালে বৈতালিকে অংশ নিতাম সকলে। সাজ ছিল স্বল্প। আমার মনে আছে, লিপস্টিক কেউ পরতাম না। শুধু টিপ। আর ফুলের গয়না। মহড়া চলত কয়েক মাস ধরে। আর এদিকে ফুলের গয়নার প্রস্তুতিও থাকত তুঙ্গে। ভেজা গামছায় মুড়ে ফুলের গয়না রেখে দিতাম সারারাত। যাতে টাটকা থাকে। এখনকার মতো পলাশের বন ধ্বংস করে সেই ফুলের মালা কেউ পরতাম না। একটা কি দুটো পলাশ ফুল খোঁপায় দিতাম। ওটাই যথেষ্ট ছিল। এখন লোকারণ্যে আবীর মাখানো নিয়েও কত কাণ্ড ঘটে। শেষ এক দশকে এত পরিবর্তন, তাই আর যাই না।" আর এক প্রবীণ আশ্রমিক কল্পিতা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, "১৯৫০ সাল থেকে বসন্তোৎসব দেখছি। সে সময় আম্রকুঞ্জে বসন্তোৎসব হত। আম্রকুঞ্জের সমস্ত গাছে নানা রঙের ওড়না বেঁধে দেওয়া হত। একটা বেদিতে বসতেন আচার্য। তার পাশে আলপনা আঁকা থাকত। সামনে বিরাট তামার পাত্রে অনেক আবীর রাখা হত। পুরনো লাইব্রেরি থেকে শুরু হত পদযাত্রা। পদযাত্রা শেষে নাচ-গানের অনুষ্ঠান। তারপর আচার্যের পায়ে সকলে আবীর দিতেন। গলায়, খোঁপায়, হাতে পলাশের মালা দিয়ে সাজের রীতি একেবারেই ছিল না। এমনকী যাঁরা বাইরে থেকে অনুষ্ঠান দেখতে আসতেন, তাঁরাও পলাশ ফুল ওভাবে ব্যবহার করতেন না। আমাদের সময় এই উৎসবে ছিল মনের আনন্দ। কোনও অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটত না। আগের সন্ধে থেকেই উদযাপন শুরু হত। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান, নাচ করতেন মেয়েরা। আম্রকুঞ্জের আলোছায়ায় অন্য এক পরিবেশ সৃষ্টি হত। রবীন্দ্রনাথের গানে বারবার দখিনা হাওয়ার কথা উঠে এসেছে। এখন এত বাড়ি, ঘর গড়ে উঠছে, সেটাও আর টের পাওয়া যায় না। মাতাল সমীরণে, চাঁদের আলোয় শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব ঘিরে আর মায়ালোক সৃষ্টি হয় না।"তবে প্রবীণ থেকে নবীন, একবাক্যে বলেছেন, গত কয়েক বছরে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের "খামখেয়ালিপনায়" লুপ্ত হয়েছে শান্তিনিকেতনের বহু ঐতিহ্য। পৌষ মেলা থেকে বসন্ত উৎসব, তালিকাটা দীর্ঘ।
  • Link to this news (আজকাল)