মেদিনীপুরের 'জায়ান্ট কিলার', দলের সফলতম ক্যাপ্টেন! দিলীপকে 'অগ্নিপরীক্ষা'-য় নামাল দল
এই সময় | ২৫ মার্চ ২০২৪
যে জায়গা হাতের তালুর মতো চেনেন তিনি, সেই পিচেই এবার আর তিনি দাঁড়াতে পারলেন না। মেদিনীপুরের (অবিভক্ত ধরলে) ভূমিপুত্র দিলীপ এবার নির্বাচনে লড়বেন বর্ধমান-দুর্গাপুর আসন থেকে। কতটা সুবিধা, কতটা অসুবিধা সে সব তো আলোচনা থাকবেই। তবে অন্য জায়গায় প্রার্থী হতে হবে তা হয়ত তিনি নিজেও একটা সময় অবধি ভাবতে পারেননি। জল্পনা চলছিল, তা সত্যিও হল। ঝাড়গ্রামের সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ছোট্ট একটি গ্রামে দিলীপ ঘোষের জন্ম। জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা থেকেই। সেই দিলীপ এবার নিজের এলাকায় প্রার্থী হতে পারলেন না! তাতে মুখে না বললেও বিজেপি কর্মীদের একটা অংশও বেশ অসন্তুষ্ট। দিলীপ রবিবার রাতে ক্যামেরার সামনে বললেন, 'কোনও সমস্যা নেই। সোমবার থেকেই ওখানে পৌঁছে যাব। গোটা রাজ্যই আমার হাতের তালুর মতো চেনা।' কিন্তু দলীয় সূত্রে খবর, নিজেও এই সিদ্ধান্ত প্রথমে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
গোটা রাজ্যই আমার হাতের তালুর মতো চেনা। কোনও সমস্যা হবে না।দিলীপ ঘোষ
জেলায় চায়ের ঠেকে রবিবারের রাতে কান পাতলেই শোনা যায়, প্রথমবার এই জেলার বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সাতবারের বিধায়ককে হারিয়ে বিজেপির হয়ে জয়লাভ করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। দিলীপের সাহসের টের পাওয়া গিয়েছিল, মেদিনীপুরে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনও ভয় ছাড়াই টানা বিরোধীতা করে যাওয়া নিয়ে। সেই সময় পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রাক্তন এক পুলিশ কর্তার ভয়ে যখন শাসক-বিরোধী সব দলের নেতারাই কাপতেন, তখন দিলীপ ঘোষ রীতিমতো অন্য মুডে। ডাকাবুকো দিলীপ ঘোষকে ভয় দেখিয়ে যে কাজ হবে না ২০১৬-১৭ সালে শাসকদলও তা ভালোভাবে টের পেয়েছিল। তাঁর তত্ত্ববধানেই রাজ্যে রাম নবমীর বিরাট শোভাযাত্রা বার হত মেদিনীপুরে। এহেন দিলীপের শুরুটা জানা আছে নিশ্চয়ই?‘দিলীপদা মানসিক চাপে আছেন’ কটাক্ষ জুন মালিয়ার
মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরেই তিনি RSS-এর প্রচারক হয়ে বিভিন্ন জায়গায় সংঘের শাখা তৈরি করেন। সে সময় জেলারই বিভিন্ন জায়গায় শাখা খোলেন। ১৯৯৯ সালে দিলীপ আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসবকের ইনচার্জ হয়ে চলে যান। ২০১৪ সাল পর্যন্ত দিলীপবাবু সংঘের প্রধানের সহকারী হয়ে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে বঙ্গ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন দিলীপ ঘোষ। কয়েক মাস পরেই রাজ্য সভাপতি হন তিনি। রাজ্য সভাপতির পদে নিযুক্ত হওয়ার পরেই দিলীপ ঘোষের দাপুটে বিরোধী তেজ ও বিতর্কমূলক মন্তব্যের জেরে রাজ্যবাসীর কাছে এক নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি । শুরুতে অবশ্য অনেকেই এমন 'মুখ খারাপ' লোককে পছন্দ করেননি। লাগামে থাকতে পছন্দ করেন না তিনি। একাধিক ইন্টারভিউতেই বলেছেন, ‘উচিত কথা বলতে আমি কাউকে ছাড়িনি।’ কিন্তু পরে অনেকেই বোঝেন, কর্মী-সমর্থকদের পাশে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে ডাকাবুকো দিলীপ একবারও ভাবেন না, ভয়ও পান না। এই সাহসই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে সবার মধ্যে।
বিজেপির অন্দরে কানাঘুষো, দলের আভ্যন্তরীন সমীক্ষায় মেদিনীপুর কেন্দ্র দিলীপের জন্য খুব একটা ভালো হত না বলেই ওঠে এসেছিল। সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত। যদিও এই যুক্তি মানতে নারাজ অনেকেই।
২০০৯ সালে আসন পুনর্বিন্যাসে তৈরি হয়েছিল বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্র। প্রথম ভোটে জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী। ২০১৪-য় তাঁকে হারিয়ে জিতেছিলেন তৃণমূলের মমতাজ সঙ্ঘমিতা। পরে ২০১৯ সালে জয়ী হন বিজেপির সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। পায়ের তলার মাটি শক্ত করে গেরুয়া শিবির। কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে এই লোকসভার অন্তর্গত সাতটি আসনের মধ্যে ৬টিতেই তৃণমূল দখল করেছিল। ফলে সেই মাটিতে দিলীপকে জিততে বেশ খাটতে যে হবে তাতে সন্দেহ নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম ভোটে লড়াই করেন তিনি। খড়গপুর সদর বিধানসভা আসনে বিজেপির প্রার্থী হন দিলীপ। খড়গপুর সদর বিধানসভায় আসনে দিলীপের লড়াইটা সহজ ছিল না। কারণ সেখানকার কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন জ্ঞান সিং সোহনপাল। তিনি ১৯৮২ সাল থেকে ২০১১ সাল সাতবার একটানা জয়ী হয়ে এসেছেন খড়গপুর সদর বিধানসভার আসন থেকে। জনপ্রিয় মানুষ এবং রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন। ডাকতেন 'চাচা' বলে। খড়গপুর সদর বিধানসভায় দিলীপ ৬১ হাজার ৪৪৬ ভোট পেয়ে জ্ঞান সিং সহনপাল কে ৬৩০৯ ভোটে পরাজিত করেন ।
২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনের পর দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াই করে বিজেপি। দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে বিজেপি জঙ্গলমহলে ভালো ফল করে বিজেপি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলের পর বিজেপিকে বাড়তি অক্সিজেন যোগায় ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে। দিলীপ ঘোষের কাঁধে ভর করেই ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন হয়। ১৮ টি লোকসভা আসন জয়লাভ করে বিজেপি। দিলীপ ঘোষের স্লোগান ‘উনিশে হাফ একুশে সাফ’ মানুষের মধ্যে ব্যাপক দাগ কাটে । দাপুটে রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন মন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মানস ভুঁইয়াকে ব্যাপক ভোটের মার্জিনে পরাজিত করেন দিলীপ ঘোষ। মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে দিলীপ ঘোষ ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৪৩৩ ভোট পান। মানস ভুঁইয়ার থেকে তার ভোটের ব্যবধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৮ হাজার ৯৫২ ভোটের।
দলে এখন কান পাতলেই শোনা যায়, অনেকটাই কোণঠাসা তিনি। তার এই কেন্দ্র বদলে সেই সমীকরণ কাজ করেছে কি না জানা নেই তাঁর অনুগামীদেরও। তবে ক্যাপ্টেন কি আবার ফর্মে ফিরে ছক্কা হাঁকাবেন? সে দিকেই তাকিয়ে অনেকে।