বাজা তোরা, রাজা যায়... একদিনের রাজত্বে সাজ বহরানে
এই সময় | ২৭ মার্চ ২০২৪
অভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কাটোয়াপথজুড়ে চলেছে সাদা ঘোড়ায় টানা রাজার রথ। বল্লম হাতে সেপাইয়ের দল চলেছে রথের আগে আগে। রথে বসে ৮৮ বছরের বৃদ্ধ রাজা অম্বিকাপ্রসাদ চট্টরাজ। এক-আধ বছর নয়, দীর্ঘ ন’বছর পরে তিনি সপার্ষদ বেরিয়েছেন নিজের নগর ভ্রমণে।
রাজা এসেছেন বলে কথা! তাঁকে স্বাগত জানাতে রাস্তার দু’ধারে ভিড় জমেছে নগরবাসীর। রাজাধিরাজের একটিবার দর্শন পেতে কে না চায়? রাজামশাই এমনিতে দয়ালু, হাসিখুশি। আবার দরকারে কড়া হাতে শাসন করেন, জরিমানাও করেন। বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই বটে, তেজ কমেনি একফোঁটাও। বেয়াদপি দেখলে রেয়াত করেন না কাউকে।
দোলের দিন নগর পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামের প্রাচীন জনপদ বহরানের রাজা অম্বিকাপ্রসাদ। আদতে তিনি রাজা নন। গ্রামের দীর্ঘদিনের ট্র্যাডিশন মেনে একদিনের জন্য রাজা করা হয়েছে তাঁকে। তবু রাজা তো! তাই সাজপোশাকে হোক বা সামগ্রিক আড়ম্বরে— রাজকীয় নিশান ছত্রে ছত্রে। প্রজাদের কথা যেমন শুনলেন মন দিয়ে, তেমন বেচাল দেখলেই করলেন জরিমানা। ছাত্র থেকে ব্যবসায়ী, রাজার নিদান মাথা পেতে নিলেন সকলে।
কেমন হলো জরিমানা? রাজা বেরিয়েছেন নগরপথে, তা-ও এত বছর পর। সে কথা জেনেও এক প্রজা বসেছিলেন বাড়িতে। এত বড় স্পর্ধা! রাজা রেগে লাল। হয়ে গেল ২০০ টাকা জরিমানা। এক ধান ব্যবসায়ী পড়লেন রাজরোষে — ‘রাজ্যের প্রজাদের থেকে ভালো ধান কিনে তাতে তুমি কাঁকর মেশাও। তোমার দুশো টাকা জরিমানা হলো।’ সময় বদলেছে। হাতে হাতে মুঠোফোন। কিন্তু রাজা বদলাননি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোনে রাজার ছবি তুলছিল এক ছাত্র। তা দেখেই রেগেমেগে রাজা বললেন, ‘ওহে, তুমি পড়া ছেড়ে সারা দিন ফোন ঘাঁটো, এখনও তা-ই করছ। তোমার একশো টাকা জরিমানা করলাম।’
২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে এই সব দৃশ্য ঠিক যেন রূপকথার মতো। তবু বাস্তব। সোমবার, দোলের দিন বহরান সাক্ষী থাকল এমনই একটি রাজকীয় দিনের। সকাল থেকে মন্ত্রী-সেপাই নিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরলেন একদিনের রাজা অম্বিকাপ্রসাদ। ন’বছর অন্তর এই গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় জয়দুর্গার পুজো। সেই পুজোতেই প্রথামতো রাজা সাজেন গ্রামের একজন। ওই দিন গ্রামে চলে তাঁর রাজত্ব। প্রায় দুশো বছর আগে এই পুজোর প্রচলনের সময়ে একজনকে রাজা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ঠিক হয়, গ্রামের সবথেকে দরিদ্র ব্রাহ্মণকে একদিনের জন্য রাজা করা হবে। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। আর এই ভাবেই সিংহাসনের উত্তরাধিকার ঘুরতে ঘুরতে একদিন অম্বিকাপ্রসাদের কপালে ওঠে রাজতিলক। তা-ও হয়ে গেল বহু দিন। রাজা অম্বিকাপ্রসাদ বলছেন, ‘এই নিয়ে সাত বার রাজা হলাম। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। একদিনের জন্য হলেও আমি রাজা! গ্রামের লোকজন রাজার মতোই মান্যি করে এ দিন। মজার ছলে শাস্তি দিই প্রজাদের, তাঁদের কথাও শুনি। জয়দুর্গার কাছে আমার প্রার্থনা একটাই, আমার প্রজারা যেন সুখে থাকে।’
প্রায় দু’শতক আগে যখন বহরান গ্রামে জয়দুর্গা পুজো শুরু হয়, তখন গ্রামবাসীদের জাঁকজমক করে পুজো করার সাধ্যি কোথায়? গরিব গ্রামবাসীরা তাই ঠিক করেন, এই বারোয়ারি পুজো করা হবে ১২ বছর অন্তর। কালক্রমে তা কমে দাঁড়ায় ন’বছরে। পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা গৌরাঙ্গ ঘোষ বলেন, ‘পুজোর নিয়মের কিন্তু কোনও বদল হয়নি। ঐতিহ্য মেনে রাজা সাজার নিয়মও একই রয়েছে।’
গ্রামের বাসিন্দা কার্তিক ঘোষ, জগন্নাথ ঘোষের জরিমানা করেছেন রাজা। তাঁরা অবশ্য জরিমানা দিয়ে বেজায় খুশি। বলছেন, ‘এই জরিমানায় আলাদা আনন্দ। আমরা এই দিনটার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করি। রাজার সঙ্গে এ দিন আমরা প্রজার মতোই ব্যবহার করি। উনি যাঁকে জরিমানা করবেন, তিনি খুশি হয়ে তা দেবেন।’ জরিমানা বাবদ সংগৃহীত টাকা যায় পুজোর খরচের খাতায়।
কাটোয়ার আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক স্বপন ঠাকুর বলেন, ‘বহরানের এই জয়দুর্গা পুজো বাংলার প্রাচীন বারোয়ারি পুজোগুলির একটি। সেই সময়ে বারোয়ারি পুজোগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল সং সাজানো। বহরানের এই রাজার বিষয়টিও তারই একটি রূপ। সং-এর ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যও আলাদা কৃতিত্বের দাবি রাখে বহরান জয়দুর্গা পুজো।’ আবার ন’বছর পরে পুজো। রাজা বৃদ্ধ হয়েছেন। সময় আর তাঁর সঙ্গ দেবে কি না, জানেন না রাজা অম্বিকাপ্রসাদ। জানে না বহরানও। গরজও নেই। ওই একটা দিন তাঁরা রাজা অম্বিকাপ্রসাদেরই প্রজা।