এই সময়: সমস্যাগুলো চেনা, সমাধানও যে খুব কঠিন, এমনটা নয়। তবু সমস্যাগুলো সরিয়ে ছবিটা বদলাতে পারা যাচ্ছে না। কলকাতার গা ঘেঁষে তৈরি সল্টলেক যদিও এখনও মাঝবয়সি, তবে সেখানকার আদি বাসিন্দাদের অনেকেই আশির কোঠায়, কেউ বা তার একটু বেশি কিংবা একটু কম। সল্টলেকের প্রবীণ নাগরিকদের একা থাকার পরিচিত সঙ্কট ক্রমশ যেন পরিণত হচ্ছে দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে।
একা থাকা প্রবীণ বা প্রবীণ যুগলদের কেউ কেউ কখনও বা দুষ্কৃতীদের সফ্ট টার্গেট হয়ে খুন বা লুটতরাজের শিকার হচ্ছেন। আবার কখনও সেই একাকিত্বের পরিণামে তাঁরা নিজেরাই হয়ে উঠছেন ঘাতক কিংবা তাঁরা বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ। বিশেষজ্ঞেদের অনেকের বক্তব্য, একাকিত্ব ওই প্রবীণদের এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাচ্ছে যে, অবসাদের সঙ্গে দিন যাপন যেন তাঁদের রোজনামচা।বুধবার সল্টলেকে স্ত্রীকে খুন করে এক বৃদ্ধের আত্মহত্যার চেষ্টার পিছনে অন্য কারণ যা-ই থাক, বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই অভিমত, পরিজনদের মধ্যে ওই দম্পতি থাকলে এ দিনের ওই ঘটনা হয়তো ঘটত না। এটা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তা কিন্তু নয়।
তখন করোনাকাল। জিডি ব্লকের একটি দোতলা বাড়িতে থাকতেন মা ও মেয়ে। পরিজনদের কেউ কেউ কখনও-সখনও ফোনে খোঁজ নিতেন তাঁদের। ২০২০-র ৭ জুন বার বার ফোন করেও তাঁদের সাড়া না-মেলায় খবর দেওয়া হয় পুলিশে। থানা থেকে পুলিশকর্মী ও অফিসাররা গিয়ে দরজা ভেঙে উদ্ধার করেন ৭৯ বছরের মা ও ৬০ বছরের মেয়ের দেহ। কেউ জানতেই পারেনি, কবে তাঁরা মারা গিয়েছেন।
২০২২-এর ২৭ মে সল্টলেকের সিডি ব্লকের একটি বাড়ির ঘটনা চমকে দিয়েছিল অনেককে। সেখানেও উদ্ধার হয়েছিল মা-মেয়ের দেহ। তবে সুইসাইড নোট লিখে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন মা ও মেয়ে। পরিবারের কর্তার মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে এতটাই একা হয়ে যান যে, অল্প কিছু দিনের মধ্যে তাঁরা ডুবে গিয়েছিলেন অবসাদে। দেহ সৎকারের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং আধার কার্ড সুইসাইড নোটের সঙ্গে রেখে আত্মঘাতী হন মা ও মেয়ে।
এতে বোঝা যায়, নিজেদের শেষ করার ব্যাপারে তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল কতটা ঠান্ডা মাথার, কতটা পরিকল্পনা মাফিক। মনোচিকিৎসকদের একটা বড় অংশের পর্যবেক্ষণ, সল্টলেকের বহু পরিবার এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, মনের কথা শেয়ার করার লোকও পান তাঁরা। তারই পরিণাম হলো, অবসাদের সাগরে ডুবে যাওয়া। বিধাননগর পুরনিগমের পরিসংখ্যান বলছে, সল্টলেকের বাসিন্দাদের ৪১ শতাংশ প্রবীণ এবং তাঁদের ১১ শতাংশই একা থাকেন।
সল্টলেকের বাসিন্দাদের অনেকের কথাতেই— এই উপনগরী এখন ওল্ড এজ হোমে পরিণত। ওই ৪১ শতাংশ প্রবীণের অধিকাংশই দম্পতি। তাঁদের সন্তানরা প্রবাসী। আর ১১ শতাংশ বাসিন্দা দিন গুজরান করেন পরিচারক-পরিচারিকাদের ভরসায়। তাঁরা প্রায় সবাই অর্থবান, সন্তানরাও পর্যাপ্ত অর্থ সাহায্য করতে পারেন তাঁদের। কিন্তু তাতে তাঁদের একাকিত্বে বাঁধ দেওয়া যাচ্ছে কই!
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিডি ব্লকে ৮২ বছরের এক বৃদ্ধাকে বাড়িতে তালাবন্ধ করে পালিয়ে যান পরিচারিকা। অথচ তাঁর ভরসাতেই মা-কে দেশে রেখে গিয়েছিলেন ইউএস-প্রবাসী মেয়ে। কার্যত দু’দিন অনাহারে কাটিয়ে কোনও রকমে বাড়ির বারান্দায় এসে ডাকাডাকি শুরু করলে পুলিশ এসে উদ্ধার করে বৃদ্ধাকে।
আবার ওই একই ব্লকে ৮৫ বছরের মা-কে তালাবন্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে। বছর কয়েক আগে সল্টলেকের এডি ব্লকে একাকী বৃদ্ধাকে বেঁধে রেখে লুটপাট করে পালিয়েছিল তাঁর পরিচারিকা। আর জিডি ব্লকে এক বৃদ্ধের পরিচারকের সঙ্গে যোগসাজস করে এক দুষ্কৃতী ফেরিওয়ালা বাড়িতে সেজে ঢুকে প্রবীণ ওই নাগরিককে মারধর করে লুটপাট করে পালিয়েছিল।
প্রবীণদের একাকিত্ব কাটাতে বিধাননগর পুলিশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করে সাঁঝবাতি নামে একটি সংস্থা। থানায় ফোন করলে পুলিশও তাঁদের সঙ্গে গল্প করার লোক পাঠায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞেদের মতে, প্রবীণদের অনেককে একাকিত্ব এতটাই গ্রাস করেছে যে, কাউকে ডেকে গল্প করার কথা ভাবার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে তাঁদের।