• ‘আব কি বার চারশো পার’ স্লোগানটির প্রতি মোদি-শাহর কি আস্থা নেই?
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৮ মার্চ ২০২৪
  • প্রবীর মজুমদার
    নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই মোদি সরকার এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷ প্রথমদিকে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী মানুষদের শহুরে নকশাল নামে দাগিয়ে অনন্তকাল জেলে আটকে রাখার ব্যবস্থা করলেন৷ ভারভারা রাও ও তাঁর আত্মীয়দের ওপর মোদি সরকারের পাশবিক কাজকর্মের স্মৃতি এর মধ্যেই ফিকে হওয়ার কথা নয়৷ ভারতের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী আর রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ঘরে পাঠাও ইডি বা সিবিআই৷ মাথা নত করে আমাদের দলে আসতে বলো, নইলে জেলে পোরো৷ এরা কিন্ত্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য জেলে পুরছে না, এদের প্রধান লক্ষ্য সাধারণের মধ্যে এঁদের প্রতি সন্দেহ তৈরি করা, এঁদের ভাবমূর্তির ক্ষতি করা, এরপর আজ সাপ্লিমেন্ট চার্জশিট, কাল প্রভাবশালী তত্ত্ব দিয়ে বছরের পর বছর জেলে আটকে রেখে এঁদের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্তব্ধ করে রাখা৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জামানায় একের পর এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেই চলেছে, যার জন্য তিনি ভারতের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন৷ এই ঘটনাগুলোর একটি ঘটে গেল গত ২১ মার্চ৷ দেশের ইতিহাসে প্রথমবার গ্রেফতার হতে হল একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়া প্রথম মুখ্যমন্ত্রী না হয়ে দ্বিতীয়ও হতে পারতেন৷ কিন্ত্ত ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন গ্রেফতার হওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করায়, কেজরিওয়াল প্রথমের শিরোপা পেলেন৷
    অন্যদিকে সোরেনের এই পদত্যাগের কারণে নতুন বছরের প্রথম তিন মাসে দুইজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করার অনাবিল আনন্দ এবং গৌরব থেকে বঞ্চিত হলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি৷ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১০০ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে দক্ষিণের মদ ব্যবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন৷ এই মামলার রাজসাক্ষী হলেন হায়দ্রাবাদস্থিত ‘অরবিন্দ ফার্মা’র কর্ণধার পি শরৎ রেড্ডি৷ ১০ নভেম্বর ২০২২ রেড্ডি গ্রেফতার হওয়ার পর ১৫ নভেম্বর রেড্ডির প্রতিষ্ঠান অরবিন্দ ফার্মা বিজেপিকে পাঁচ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দিয়েছে৷ ২০২৩ সালের মে মাসে রেড্ডি স্বাস্থ্যজনিত কারণে জামিন পান৷ সরকারের তরফে জামিনের বিরোধী করা হয়নি৷ জুলাই মাসে রাজসাক্ষী হওয়ার ২ মাস পরে আবার তিনি বিজেপিকে ২৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দিয়েছেন৷ বিজেপিকে বিভিন্ন খেপে ৩৪ কোটি টাকা দান করেছেন তিনি৷ অভিযুক্তের বোধোদয় হতেই পারে, সে-নিয়ে সমস্যা ছিল না৷ যদি না ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য প্রকাশিত হত৷ রেড্ডির প্রতিষ্ঠান মোট ছয়বার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে৷ গ্রেফতারির আগে দুইবার এবং গ্রেফতারির পর চারবার৷ কিন্ত্ত দেখা যাচ্ছে গ্রেফতারির আগে তিনি একবার তেলুগু দেশম পার্টিকে ২.৫ কোটি এবং ভারত রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘকে ১৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দেন৷ গ্রেফতারির পরের চারবারই টাকা পেয়েছে বিজেপি৷ সুতরাং রেড্ডির কাছ থেকে বিজেপির অ্যাকাউন্টে যাওয়া এই অর্থকে চাঁদা না ভেবে অনেকে তোলা ভাবছেন৷ ফলত রেড্ডি স্ব-ইচ্ছায় রাজসাক্ষী দিচ্ছেন নাকি কোনও হুমকি, ব্ল্যাকমেলিং বা চাপের মুখে তিনি এটা করছেন, সেই প্রশ্নও উঠতে বাধ্য৷ নির্বাচনের ঠিক মাস খানেক আগে যখন জোট, ঘোঁট, দলবদল, প্রার্থী ঘোষণার প্রক্রিয়া তুঙ্গে, তখন পর পর দুইজন মুখ্যমন্ত্রী স্তরের মানুষকে গ্রেফতার কি বিরোধী দলগুলোর মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বা নীতিনির্ধারক নেতাদের বার্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা নয়? দুর্নীতির তদন্তে একান্তভাবে যদি গ্রেফতার করতেই হত, তবে কি নির্বাচন অব্দি অপেক্ষা করা যেত না?
    কেজরিওয়াল গ্রেফতার না হলে কি “দেশের নিরাপত্তা”র বিঘ্ন ঘটত? পরপর নজিরবিহীন গ্রেফতারি কি এই বার্তা দেয় না যে, শাসকদল একদিকে অবাধ্য নেতাদের উপর মানসিক চাপ তৈরি করে বিরোধীদের ঘরে ফাটল ধরাতে চাইছে? আর তাই ফাটল ধরানো হচ্ছে, বিজেপির দলীয় ক্ষমতার জোরে নয়, বরং প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে! অন্যদিকে ভোটারদের মনেও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ আর আমাদের মতো পশ্চাৎপদ দেশে এক বড় অংশের মানুষই বিজয়ীর দলে সামিল হতে বেশি ভালবাসে৷
    কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক মুনাফা তুলতে ব্যবহার করার অভিযোগ নতুন নয়৷ গত ১৮ বছর ধরে নথিভুক্ত গ্রেফতার, অভিযান বা জিজ্ঞাসাবাদের রিপোর্ট খতিয়ে দেখে জানায়, এই সময়কালে প্রায় ১৪৭ জন বড় নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে সিবিআই৷ তার মধ্যে ৮৫ শতাংশেরও বেশি বিরোধী শিবিরের৷ প্রশাসনিক কাঠামোকে দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর আরেকটি উদাহরণ হতে পারে এসবিআই-র নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্য গোপন করার চেষ্টা৷ যা প্রধানমন্ত্রী মোদির জমানায় আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের চাপে একটুর জন্য, জনতার কাছে তথ্য চেপে রাখার গৌরব প্রধানমন্ত্রী মোদির অর্জিত হল না৷ প্রকাশ হওয়া নির্বাচনী বন্ডের তথ্যও কেজরিওয়ালের মামলা এবং ভারতের গণতন্ত্রের হালহকিকৎ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে পারে৷ ঝাড়খণ্ড এবং দিল্লি, এই দুই রাজ্যের মধ্যে আভিজাত্যে, সংস্কৃতিতে, জাতীয় গুরুত্বে ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও, মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারে দুই রাজ্যের কিছু মিল আছে৷ দুই রাজ্যেই কিন্ত্ত নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেফতারির পেছনে আছেন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপাল বা উপরাজ্যপাল৷ যে পদ দুটি অনির্বাচিত এবং কেন্দ্রের দ্বারা মনোনীত৷ একসময় কেন্দ্রের নির্দেশে সরাসরি রাজ্যপাল রাজ্যের নির্বাচিত সরকার ভেঙে দিতেন৷ তার ফলে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়৷ শাসক অভিজাতদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তৈরি হয় বিরক্তি৷ ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা থেকে একই সঙ্গে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন, অন্যদিকে জয়প্রকাশ নারায়ণের “সম্পূর্ণ ক্রান্তি” আন্দোলন ঘটে গেছে৷ এই দুই ধারার দুই আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ক্রান্তি না আনতে পারলেও, রাজ্য সরকার নিয়ে ছেলেখেলা অন্তত কমেছে৷
    যদিও রাজ্য সরকারকে উত্যক্ত করার স্টাইল বদলেছেন মহামহিম বা রাজ্যপালেরা৷ গ্রেফতারির পর বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় আস্থাভোটে উপস্থিত হয়েছিলেন হেমন্ত সোরেন৷ সোরেন স্পষ্টভাবে তাঁর গ্রেফতারির পেছনে রাজ্যপালের ভূমিকার কথা উল্লেখ করন৷ অন্যদিকে দিল্লি আবগারি মামলার ক্ষেত্রেও মূল উদ্যোক্তা হিসেবে হাজির হয়েছেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিজে৷ একদিকে হেমন্ত সোরেন যেমন আদিবাসী আত্মপরিচিতির উপর রাজনীতি করেন, তেমনি কেজরিওয়ালের রাজনীতির মূল ভিত্তিই হল দুর্নীতির বিরোধিতা৷ তাই দুর্নীতির মামলায় কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি অবশ্যই তাৎপর্য্য বহন করে৷ কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়ার পর যদি তার দল ভেঙে না যায়, তবে বলাই যায় যে, তিনি বিপুল শক্তি ও সমর্থন নিয়ে জেল থেকে বেরোবেন৷ আর ২০২৪ সালের পরেও যদি ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র টিকে থাকে, তবে সেটা বিজেপির ঘাঁটি গুজরাতের ওপরেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে৷ কিন্ত্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আবার ভাবাতে বাধ্য, সেটা হল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক৷ যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নির্বাচিত এবং কর্মরত মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হতে পারেন, সেই কাঠামোকে আর কতদিন যুক্তরাষ্ট্রীয় বা গণতান্ত্রিক বলা যায়?
    গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খবরের চ্যানেলে চ্যানেলে এখন থেকেই নরেন্দ্র মোদীকে জিতিয়ে দেওয়ার বার্তা ছডি়য়ে দেওয়া হচ্ছে৷ বলে দেওয়া হচ্ছে দেশের কত শতাংশ মানুষ বিজেপিকে আবার ক্ষমতায় আনতে চান৷ যেন নির্বাচনের ঠিক আগে এই ধরনের সমীক্ষার মাধ্যমে জনগণের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তুমি যাকেই ভোট দাও, ‘আয়োগা তো মোদী হি’৷ আর যারা মোদীভক্ত তাদের মনোবলও বাডি়য়ে দিচ্ছে টিভি চ্যানেলের জনমত সমীক্ষা৷ এই সমীক্ষাগুলি কতটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ কিন্ত্ত সমীক্ষার নম্বরের ছটায় সেই প্রশ্নগুলি অন্ধকারে চলে যাচ্ছে৷ দিনের শেষে কয়েকটি নম্বর বলে দিচ্ছে কোন রাজ্যে কে কতগুলি আসন পাবে৷ কিন্ত্ত কোন কোন আসনগুলি কে পাবে তার হিসাব কিন্ত্ত বিশদে দিচ্ছে না সমীক্ষাগুলি৷
    এই নির্বাচনে বিজেপি ও এনডিএ জোটকে ৪০০ পার করতে গেলে বা তার কাছাকাছি পৌঁছতে গেলে নতুন ভোটারদের ভোট দরকার হবে৷ নিজেদের মূল ভোটব্যাঙ্কের উপর ভরসা করে বসে থাকলে হবে না৷ বিশেষত দক্ষিণ ভারতে বিজেপিকে অনেক বেশি আসন জিতে আসতে হবে৷ এই পরিস্থিতিতে প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা শাসক দলের প্রচার করে দিচ্ছে না তো? আরও যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে, সংসদে “আব কি বার চারশো পার”স্লোগানটির প্রতি নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর কি আস্থা নেই?
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)