• ‘এক দেশ এক ভোট’ ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে বিপজ্জনক
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ২৮ মার্চ ২০২৪
  • পুলক মিত্র
    ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর পক্ষে বারবার মুখ খুলতে দেখা গেছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে৷ সেই ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে ২০২৩-এর ২ সেপ্টেম্বর তিনি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন৷ ১৯১ দিন ধরে নানা শলাপরামর্শের পর ২০২৪-এর ১৪ মার্চ রামনাথ কোভিন্দ কমিটি ১৮,৬০০ পাতার যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে মোদিরই ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে৷
    একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে কোভিন্দের উচিত ছিল, এ ধরনের বিতর্কিত এবং অসাংবিধানিক বিষয় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা৷ দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাজ করার পর একজন ব্যক্তির কখনই কোনও রাজনৈতিক আনুগত্য থাকা উচিত নয়৷ দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে বিতর্কিত রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর জড়িত হওয়া, কখনই কাম্য হতে পারে না৷
    প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এবং পরবর্তীকালে তাঁর দলও আনুগত্যপরায়ণ রাষ্ট্রপতিই পছন্দ করতেন৷ কিন্ত্ত যে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে বরাবর একজন ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাবি করে এসেছেন, তাঁর উচিত ছিল, রাষ্ট্রপতি ভবনকে এই বিতর্কের বাইরে রাখা৷ তবে কোভিন্দের কমিটি কী সুপারিশ করতে পারে, তার একটা আগাম আন্দাজ পাওয়া গিয়েছিল৷ কারণ, কমিটিতে ছিলেন দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী – স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং আইন মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল৷ তাই কমিটি মোটেই নিরপেক্ষ ছিল না, তা নির্দ্বধায় বলা যায়৷ এছাড়া, কমিটিতে ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা নেতা গুলাম নবি আজাদ, অর্থ কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এন কে সিং এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী হরিশ সালভে৷
    কমিটির একসঙ্গে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করা৷ দেশে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৫২ সালে৷ স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম নির্বাচনে লোকসভা ও বিধানসভাগুলির ভোট একসঙ্গে হয়েছিল৷ দুটিরই কার্যকালের মেয়াদ ছিল ৫ বছরের৷
    ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ তবে ১৯৬৮ এবং ’৬৯ সালে কয়েকটি রাজ্যের সরকার এবং ১৯৭০ সালে কেন্দ্রের সরকার ভেঙে গেলে পরিস্থিতি বদলে যায়৷ এর পর থেকে৷ ধীরে ধীরে সাধারণ নির্বাচন এবং বিধানসভা নির্বাচন আলাদা হতে শুরু করে৷ যদিও সংবিধানের প্রণেতারা এ ধরনের ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতা নিয়ে কোনও কিছু সুপারিশ করেননি৷
    সংবিধানের ৮৩ (২) এবং ১৭২ (১) ধারা অনুযায়ী, লোকসভা এবং বিধানসভাগুলির স্থায়িত্ব ৫ বছরের, যদি না কোনও কারণে তা মেয়াদ ফুরনোর আগেই ভেঙ্গে যায়৷
    ১৯৯৩-এর এপ্রিলে সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪ তম সংশোধনীর আগে পর্যন্ত পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির নির্বাচন সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা ছিল না৷ বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচনকে তেমন গুরুত্ব দিত না৷ তাই নির্বাচনও ছিল অনিয়মিত৷
    ১৯৬০ সালে ৩৫৬ ধারা জারি করে কেরালায় সরকার ভেঙ্গে দেওয়া হয়, যা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রথম আঘাত৷ এরপর দুর্বল কংগ্রেস এবং অপরিণত বিরোধী দলের কারণে ১৯৬৭ সালে দেশের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনেও একই জিনিস ঘটে৷ বলতে গেলে, তখন থেকেই দেশের দলীয় ব্যবস্থা নতুন চেহারা নিতে শুরু করে৷
    এরপর দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়৷ মেয়াদ ফুরনোর আগেই সরকার ভেঙ্গে যেতে থাকে, যা সংসদীয় ব্যবস্থায় এক ধরনের অস্থিরতার জন্ম দেয়৷ দলবদল এবং ঘোড়া কেনাবেচার মতো জনপ্রতিনিধিরাও বিক্রি হতে থাকেন৷
    ১৯৭১ সালে দেশে প্রথম মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়৷ নির্দিষ্ট সময়ের এক বছর আগেই সরকার ভেঙ্গে দেন ইন্দিরা গান্ধি৷ বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন তিনি৷ ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেন ইন্দিরা৷ এরপর ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে হেরে যায় কংগ্রেস৷ কিন্ত্ত এর মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৮০ সালে দেশে আবার ভোট হয়৷ ক্ষমতায় ফেরেন ইন্দিরা৷ তিনি রাজ্য বিধানসভাগুলি ভেঙ্গে দেন৷ ১৯৮২তে ভেঙ্গে দেওয়া বিধানসভাগুলিতে ফের নির্বাচন হয়৷
    এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না, ৩৫৬ ধারার যথেচ্ছ অপব্যবহার না করা হত৷
    এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৮৩ সালেও লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে সেরে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন৷ কিন্ত্ত তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার এর বিরোধিতা করে৷ ১৯৯৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্টেও একযোগে নির্বাচনের জন্য জোর দেওয়া হয়েছিল৷
    ২০২২-এর ডিসেম্বরে, আইন কমিশন দেশে একযোগে নির্বাচন করার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দল, ভারতের নির্বাচন কমিশন, আমলা, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়েছিল৷
    কোভিন্দ কমিটি লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন যেমন একসঙ্গে করার পক্ষে মত দিয়েছে, তেমনই সেই নির্বাচনের ১০০ দিনের মধ্যে পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় নির্বাচনও সেরে ফেলার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে৷ দেশের ৬৭টি রাজনৈতিক দলকে তাদের মতামত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল রামনাথ কোভিন্দ কমিটি৷ এর মধ্যে ৪৭টি দল জবাব দিয়েছিল৷
    একসঙ্গে গোটা দেশে ভোট করানোর পক্ষে মত দিয়েছে ৩২টি দল, যার মধ্যে রয়েছে বিজেপি সহ এনডিএ জোটের প্রায় সবকটি দলই৷ অন্যদিকে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সহ ১৫টি দল এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে৷
    জাতীয়-স্তরে স্বীকৃত দলগুলির মধ্যে ৬টি দল তাদের মতামত ব্যক্ত করেছিল, যার মধ্যে মাত্র দুটি দল – বিজেপি ও ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি সমর্থন করেছে একসঙ্গে সব ভোট করার পক্ষে মত দিয়েছে৷ কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, সিপিআইএম এবং বহুজন সমাজ পার্টি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে৷
    ভারতের সংবিধানে লোকসভা, রাজ্যসভা এবং রাজ্যগুলির বিধানসভার আলাদা মর্যাদা রয়েছে৷ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলির অধিকার এবং দায়িত্বও নির্দিষ্ট করে রয়েছে৷
    একসঙ্গে সারা দেশে ভোট হলে, সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরেই আঘাত আসবে বলে মনে করছে বিরোধী দলগুলি৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ব্যবস্থা চালু হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বিজেপি৷ তাঁদের মতে, স্বাভাবিক প্রবণতা হল, দুটি ভোট একসঙ্গে হলে একই দলের প্রার্থীকেই বেছে নেন মানুষ৷ সেক্ষেত্রে কেন্দ্রে আর রাজ্যে একই দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে৷
    ২০১৫ সালে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল৷ তাতে দেখা গিয়েছে, একই সময়ে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হলে, ৭৭ শতাংশ ভোটার একই দলকে ভোট দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন৷ আর ৬ মাসের ব্যবধানে দুটি নির্বাচন হলে, ৬১ শতাংশ ভোটার এক দলকে বেছে নেবেন বলে জানিয়েছেন৷
    একবার না হয় লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভাগুলির ভোট একসঙ্গে হল৷ কিন্ত্ত প্রশ্ন হচ্ছে, কোনও রাজ্য সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে, তখন কী হবে? পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বিধানসভা জিইয়ে রেখে দিয়ে কি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হবে? আবার কেন্দ্রীয় সরকার যদি কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় (গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যেমনটি হয়েছিল), তখন কি নির্বাচন পর্যন্ত জন্য অপেক্ষা করতে হবে? কারণ, কেন্দ্রে তো আর রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা সম্ভব৷ ভারতের সংবিধানে এই ধরনের কোনও ব্যবস্থাও নেই৷ ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, ?এক দেশ এক ভোট?-এর সুপারিশকে সামগ্রিকভাবে অসাংবিধানিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)