ভোটবঙ্গে আচমকা সুপারহিট! গোপাল ভাঁড় কি কাল্পনিকই?
এই সময় | ৩০ মার্চ ২০২৪
জয় সাহা
দাবি ১: ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রতিবাদ করে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাত্যাগ করেন গোপাল ভাঁড়।
দাবি ২: পলাশির যুদ্ধের আগে কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলানোয় এতটাই প্রতিবাদ করেছিলেন গোপাল ভাঁড় যে, রেগে তাঁর ফাঁসির আদেশ দেন রাজা!
দাবি ৩: আদতে নবাব সিরাজদৌল্লার অত্যাচার থেকে সনাতন ধর্মকে বাঁচাতে গোপাল ভাঁড়ই মহারাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধি করতে।লোকসভা নির্বাচনের আবহে আচমকা প্রাসঙ্গিক গোপাল ভাঁড়। তাঁকে নিয়ে দাবি, পাল্টা দাবির অন্ত নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার নানা প্রান্তে সে সব ঘুরেও বেড়াচ্ছে দেদার। যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই কৃষ্ণনগর, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর বিদূষক বলে পরিচিত গড় বাঙালির ছেলেবেলার সঙ্গী গোপাল ভাঁড়। গোপালকে নিয়ে গত কয়েক দিনে এত কিসিমের দাবি সামনে এসেছে যে, অনেকে ঠাট্টা করে বলছেন, গোপাল বেঁচে থাকলে নির্ঘাত টিকিট পেতেন। তা সম্ভব নয়। তবে গোপালের কাহিনি ফিরে ফিরে আসছে নানা রাজনৈতিক ন্যারেটিভে।
আলোচনা তীব্রতর হয়েছে দিনকয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কৃষ্ণনগরের বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায়ের ফোনে কথাবার্তার পরে। রাজপরিবারের সদস্যা অমৃতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেন, কৃষ্ণচন্দ্রের ব্রিটিশ পক্ষে যোগ দেওয়া নিয়ে বিরোধীরা অপপ্রচার করছে। কিন্তু সনাতন ধর্মকে বাঁচাতেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। আর এ প্রসঙ্গেই গোপাল ভোটের ময়দানে প্রচারের মাধ্যম হয়ে উঠেছেন। কৃষ্ণনগরেও গোপালের স্মৃতিতে তৈরি নাগরিক কমিটির সদস্যরা সক্রিয়তার মাত্রা বাড়িয়েছেন। গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্বের স্বীকৃতি এবং লোকমুখে ঘুরে বেড়ানো স্মৃতি বিজড়িত এলাকা, বাড়িগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের দাবি তুলেছেন। কার্টুন ক্যারেক্টার হিসেবে নয়, গোপাল ভাঁড়ের 'বাস্তবিক' অবয়বের মূর্তি প্রতিষ্ঠার দাবিতেও তাঁরা সরব।
কিন্তু এত যে দাবি, তার সত্যতা কতটা? গোপাল ভাঁড় আদৌ ছিলেন? সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক কণাদ সিনহা জানাচ্ছেন, গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে মূলত দু'রকমের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সুকুমার সেন, গৌতম ভদ্ররা দাবি করেছেন গোপাল একটি কাল্পনিক চরিত্র। কারণ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সভাসদ হিসেবে গোপাল ভাঁড়ের নাম কোনও প্রামাণ্য নথিতে নেই। কৃষ্ণচন্দ্রের আরও দুই সভাসদ ভারতচন্দ্র রায় এবং রামপ্রসাদ সেনের লেখনিতে অন্য নানা সভাসদের নাম পাওয়া গেলেও গোপালের নাম পাওয়া যায় না। ১৯২০-র দশকে নগেন্দ্রনাথ দাস নামে এক ব্যক্তি 'নবদ্বীপ-কাহিনী' বলে একটি বই প্রকাশ করেন। এবং সেখানে তিনি প্রথম তুলে ধরেন গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পর্ক এবং নিজেকে গোপালের বংশধর হিসেবে দাবি করেন। তারপর থেকে আরও অনেক গবেষণাতেই গোপালকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে দাঁড় করানোর দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র তাঁর অবস্থানে অনড়। নির্বাচনী মরশুমে গোপালের এই নব-উত্থান প্রসঙ্গেও তাঁর দাবি, 'গোপাল ভাঁড়, বীরবল, মোল্লা নাসিরুদ্দিনদের গল্পে ইতিহাস খোঁজাটা পণ্ডশ্রম। গোপালের মতো চরিত্রগুলিকে তৈরি করা হয়েছে। নানা প্রয়োজনে গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে নানা গল্প-গাথা নানা সময়ে তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে গোপাল ভাঁড়ের জনপ্রিয়তাকে আমরা অবশ্যই কুর্নিশ জানাতে পারি, কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে এর আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। চরিত্রটি পুরোপুরি লোকমুখে তৈরি হওয়া এক কিংবদন্তি। তাই এখন নির্বাচনী মরশুমেও কোনও রাজনৈতিক প্রয়োজনে গোপালকে নিয়ে এই সব গল্প তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয়।' বাংলার পলাশির যুদ্ধ, ষড়যন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়। তাঁর বক্তব্য, 'গোপাল ভাঁড়ের রাজনৈতিক কোনও অভিসন্ধির কথা আমি অন্তত পাইনি। অন্য কোনও জায়গাতেও আমি পাইনি যে, গোপাল ব্রিটিশদের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের হাত মেলানোর বিরুদ্ধে বা পক্ষে ছিলেন। তবে আমার মনে হয়, গোপাল ভাঁড় একেবারে কাল্পনিক চরিত্র নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সোর্সেই গোপালের অস্তিত্বের দাবি করা হয়েছে।'
প্রবীণ গবেষক-সাংবাদিক সুজিত রায় গোপালের জীবনের উপর প্রামাণ্য বই লিখেছেন। তাঁর মতো আরও অনেকেই মনে করেন, হাজার বিতর্কের মধ্যেও গোপাল ভাঁড় ঐতিহাসিক চরিত্র। তবে সুজিতও মেনে নিচ্ছেন, গোপালকে নিয়ে যে সব দাবি করা হচ্ছে তার কোনও রেফারেন্স তিনি কোথাও পাননি- 'যে সময়ের কথা, সে সময়ের বহু প্রামাণ্য নথি হারিয়ে গিয়েছে, নষ্ট হয়েছে অথবা চুরি হয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমি খানাকুলে একটি জমির সন্ধান পেয়েছি। স্থানীয়দের দাবি সেখানে গোপালচন্দ্র নাই তাঁর দাদা কল্যাণচন্দ্র নাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। যদিও এখনও প্রামাণ্য দলিল হাতে পাইনি।'
এই গোপালচন্দ্র নাইকেই সুজিত গোপাল ভাঁড় বলে দাবি করছেন। গোপালের বংশধর বলে পরিচয় দেওয়া নগেন্দ্রনাথ দাসের পরিবার এখনও থাকেন কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট লাগোয়া রাধাপ্রসাদ লেনে। সেই পরিবারের প্রবীণ সদস্য মলয় দাস জানান, তাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা গোপাল ভাঁড়েরই বংশধর। সে কারণে খানাকুল থেকে শুরু করে নানা জায়গায় এই ৭২ বছর বয়সেও মলয়রা দৌড়ে বেড়ান। মলয় জানান, আজ, শনিবার তিনি কৃষ্ণনগরে গোপাল ভাঁড়ের নামাঙ্কিত মেলায় যাবেন এবং সেখানে স্মৃতি রক্ষার দাবি নাগরিক উদ্যোগের সঙ্গেও তিনি যুক্ত আছেন। সেই আলোচনাতেও তিনি যোগ দেবেন।
গোপাল হয়তো মিথ। কিন্তু উত্তপ্ত ভোটের ময়দানে তিনি এখন যে অন্যতম প্রধান এক চরিত্র, এটুকু নির্জলা বাস্তব।