• Solar Eclipse : শুনতে কি চাও সূর্যগ্রহণের সাউন্ড অফ লাইট?
    এই সময় | ৩১ মার্চ ২০২৪
  • আচ্ছা, ধরুন যদি এমনটা হয়! চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙল, আর আপনার সামনে আলো উছলে পড়ল না। বরং, গুরুগম্ভীর একটা শব্দ ভেসে এল। বা, আপনি তাকিয়ে আছেন সূর্যগ্রহণের দিকে, স্পেশাল সোলার ফিল্টার গ্লাস চোখে লাগিয়ে। চাঁদ সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছে, চারদিক হঠাৎ আচ্ছন্ন অজানা অন্ধকারে, আর আপনার কানে ভেসে আসছে বিশেষ এক শব্দ। সূর্যগ্রহণের শব্দ!মনে হচ্ছে তো, কী সব আবোল-তাবোল…পাগলের মতো…! সূর্যগ্রহণ আবার কী শুনবে? হ্যাঁ, সেই সময়ে চার দিক অন্ধকার হয়ে যায় বলে পাখিরা সন্ধে হচ্ছে ভেবে একটু ডাকাডাকি করে বটে! কিন্তু সূর্যগ্রহণের শব্দ, চাঁদের আলোর শব্দ— এ সব কী ভাঁওতাবাজি!

    আলো তো দেখার জন্যই? আলো আবার শোনা যায় নাকি?

    বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের ছোট্ট, কিন্তু দৃঢ় উত্তরই দিচ্ছেন। হ্যাঁ, আলো শোনা যায়। একটু সঠিক ভাবে কান পাততে হবে শুধু।

    বছর দেড়েক আগে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ম্যাজিকগুলো হয়তো মনে আছে অনেকের। নতুন এই টেলিস্কোপ মহাকাশকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে পেশ করেছিল আমাদের সামনে।

    জ্যোতির্বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষ— সবাই মোহিত ছিলেন ওই টেলিস্কোপের পাঠানো মহাকাশের ছবিগুলোতে। কিন্তু ওই ছবিগুলো কি কোনও দৃষ্টিহীনের বোধগম্য হবে? তাঁর কাছে বর্ণনা করা যেতে পারে কিছুটা। কিন্তু তাঁর অনুভব তৈরি করা তো সম্ভব নয়। সেই কাজটাই করছেন ইউএসএ, কানাডা, ইংল্যান্ড ও নিউ জ়িল্যান্ডের মোট আটজন বিজ্ঞানী।

    তাঁদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন কমিউনিকেশন’ জার্নালে। নাসার মহাকাশের একগুচ্ছ ছবি, সে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ হোক বা চন্দ্র অবজ়ারভেটরির ছবি, সেগুলোর ‘সোনিফিকেশন’ করেছেন তাঁরা। সোনিফিকেশন কী? যা আদতে আলো, তা থেকে শব্দ তৈরি করে ফেলাকেই বলে সোনিফিকেশন। টেলিস্কোপের ডেটাকে শব্দে ট্রান্সলেট করার নাম সোনিফিকেশন। আলো মানে তরঙ্গ।

    সেই তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্ক বদলে নিয়ে আসা হয়, মানুষের শ্রবণ যোগ্য কম্পাঙ্কে। ধরা যাক, টেলিস্কোপে দেখা যাচ্ছে, একটি ব্ল্যাকহোল। তার প্রান্ত থেকে ছিটকে আসা আলো টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। সেই আলোর তরঙ্গ বদলে তৈরি করা হল শ্রবণযোগ্য কম্পাঙ্ক। এ বার যে শব্দ তৈরি হবে, তা আসলে ওই ব্ল্যাকহোলের চারপাশ থেকে তৈরি হওয়া আলোর শব্দ।

    ৩১৮৪ জন দৃষ্টিহীন বা অল্প দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষকে নিয়ে পরীক্ষা করেছেন ওই বিজ্ঞানীরা। তাঁদের শোনানো হয়েছে মহাকাশের নানা শব্দ। উদ্দেশ্য, তাঁদের জন্য মহাকাশের শব্দ ভাণ্ডার খুলে দেওয়া। মহাকাশের অনন্য অনুভূতি তৈরি করা। তবে এই ধরনের গবেষণা নতুন নয়। শব্দতরঙ্গ নিয়েও এমন কাজ আগে হয়েছে। যেমন, জলের নীচে তিমি যে শব্দ তৈরি করে, তার বেশিরভাগটাই মানুষের শ্রবণ শক্তির বাইরে।

    বিজ্ঞানীরা তার কম্পাঙ্ক বদল করে শ্রবণযোগ্য করলে, কানে এসে পৌঁছয় গুরুগম্ভীর সুরেলা শব্দ। যাঁকে বিজ্ঞানীরাই নাম দিয়েছেন, ‘হোয়েল সং’। হার্ভার্ড অ্যান্ড স্মিথসোনিয়ানের সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অ্যাস্ট্রোনমার এবং ইঞ্জিনিয়াররা মিলে সাত বছর আগেই বানিয়েছিলেন সোনিফিকেশন ডিভাইস।

    তাঁদের প্রজেক্টের নাম ছিল, দ্য লাইটসাউন্ড প্রজেক্ট। এই সোনিফিকেশন ডিভাইসটি ছোট্ট, এর কাজ কোনও আলোকে শ্রবণযোগ্য শব্দে পরিণত করা। তবে মূলত সূর্যগ্রহণের শব্দ নিয়েই পরীক্ষা করতেন তাঁরা। ওই বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা ছিল ২০১৯ সালের ২ জুলাই। সে দিন সূর্যগ্রহণ ছিল চিলি ও আর্জেন্তিনায়। দু’দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে যে ভাবে সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল, সেই আলো থেকে তাঁরা শব্দ তৈরি করেন সোনিফিকেশনের মাধ্যমে।

    তবে কম্পাঙ্কগুলো তাঁরা সেট করেছিলেন বিভিন্ন মিউজ়িক ইনস্ট্রুমেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে। যেমন, ক্ল্যারিওনেট, বাঁশি, ব্যাসুন ইত্যাদি। ফলে সূর্যগ্রহণের যে শব্দ শোনা গিয়েছিল, তা এই সব যন্ত্রগুলি থেকে তৈরি হওয়া। নাম দেওয়া হয়েছিল সিম্ফনি অফ লাইট। মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে থাকা সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্ররা যে শব্দ তৈরি করে, এটা বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল না। চার-পাঁচশো বছর আগেও তার একটা ধারণা ছিল। প্রাচীন গ্রিসে ‘মিউজ়িকা ইউনিভার্সালিস’ নামে এক থিওরি ছিল।

    অনেকের মতে, যা আসলে পাইথাগোরাসের তৈরি করা থিওরি। এই থিওরি অনুযায়ী, প্রতিটা গ্রহ তার কক্ষপথে ঘোরার সময়ে একটা শব্দ তৈরি করে। এর পরে জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার একটি বই লেখেন, নাম ‘হারমোনিস মুন্দি’। এই বইয়ে তিনি দেখান, পাশাপাশি কক্ষপথে থাকা দু’টি গ্রহের অ্যাঙ্গুলার স্পিড নির্ণয় করতে গেলে, তাদের মধ্যে একটি হারমোনিক প্রোপোর্শন তৈরি হয়, কেপলারের মতে সেটি ছিল দু’টি মিউজ়িক্যাল নোটের হারমোনিক রেশিওর সমতুল।

    কেপলার মনে করেছিলেন, গ্রহগুলো এক সেলেস্টিয়াল কয়্যার তৈরি করে। যেখানে শনি ও বৃহস্পতি হল বেস, মঙ্গল টেনির, শুক্র ও পৃথিবী হল অ্যাল্টো এবং বুধ সোপ্রানো। ঠিক এ ভাবে না হলেও, সোনিফিকেশনের মাধ্যমে শোনা যায়, কোন আলোর কী শব্দ! সূর্যের দিকে না চেয়েও কানে ঝিলমিল লেগে যেতে পারে!
  • Link to this news (এই সময়)