এমন কথা জনসভায় খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেই নিজের মুখে বলতে শোনা গিয়েছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জনসভাতেও প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেই নিজেকে মোদী বলে সম্বোধন করছেন। তাঁর মুখে অহরহ শোনা যাচ্ছে, ‘ইয়ে মোদী কা গ্যারান্টি হ্যায়!’ এক সময়ে মোদীর মুখে মাঝেমধ্যেই শোনা যেত, ‘বাঃ মোদীজি বাঃ!’ যা এখনও ইন্টারনেটে ভাইরাল।অর্থাৎ, সব মিলিয়ে নিজের ব্র্যান্ডিং অনেকটা নিজেই করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। কিন্তু বাংলায় তাঁর সমালোচকদের একাংশ প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারণ না-করেও তাঁর সমালোচনা করছেন। তাঁরা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন অন্য একটি নাম। ‘মোদীজি’র বদলে ‘উনিজি’। অর্থাৎ, সমালোচকদের কাছে ব্যাপারটা যেন এই রকম— ‘জি’ যেহেতু বলা হচ্ছে, তাতে অসম্মানের অভিযোগ হয়তো আনা যাবে না, তবে একই সঙ্গে ‘উনি’ ব্যবহারে থাকছে প্রচ্ছন্ন কটাক্ষ।
তাঁদের লেখায়, ভাষণে উঠে আসছে ‘উনিজি’। সমালোচনা বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের লেখায় তাঁরা মোদীর ব্র্যান্ডিং করবেন না বলেই এমন সম্বোধন। লোকসভা ভোটের মুখে এটা আরও বেড়েছে।
কিন্তু কী ভাবে মোদীজি হয়ে উঠলেন উনিজি?
‘উনিজি’ সম্বোধন করা অনেকের দাবি, প্রাবন্ধিক এবং একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ই কয়েক বছর আগে তাঁর ধারাবাহিক মোদী-বিরোধী লেখাগুলোয় ‘উনিজি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ইউএসএ-প্রবাসী সৈকত বলছেন, ‘উনিজি কথামৃত নামে আমার সাত-আটটি লেখার একটি সিরিজ় সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। আমি মনে করি, পাপ্পু, মাননীয়া— বিজেপির তৈরি এ সব ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে উনিজির-ও জনপ্রিয়তা চমকপ্রদ।’
মোদীজির বদলে ‘উনিজি’— এই ভাষ্যে সুর মেলাতে দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকদের একাংশকেও। তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র ও কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলার অরূপ চক্রবর্তী কিছু দিন আগেই সিএএ এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করতে গিয়ে মোদীর নাম উল্লেখ না-করে তাঁকে ‘উনিজি’ বলে সম্বোধন করেছেন। কেন?
অরূপের বক্তব্য, ‘উনিজি কিন্তু পার্লেজির (একটি কোম্পানির মিষ্টি বিস্কুট) মতো নয়! আসলে সামাজিক মাধ্যমগুলোয় বিজেপির প্রভাব এতটাই যে, মোদী বা বিজেপির নাম উল্লেখ করে সমালোচনামূলক পোস্ট করা হলে তা চেপে দেওয়া হচ্ছে। প্রচার করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে, মোদীর নাম না-নিয়ে তাঁকে উনিজি বললেই এখন মানুষ বুঝে যাচ্ছেন।’
সমালোচকদের কারও কারও মত— সোশ্যাল মিডিয়ার এআই এখনও বুঝতে পারছে না, উনিজি কে! মোদীর কট্টর সমালোচক হিসেবে বিভিন্ন পোস্ট করেন রাজনৈতিক কর্মী সুমন সেনগুপ্ত। তাঁর বক্তব্য, আসলে মোদীজি ব্র্যান্ডকে কাউন্টার করতে তাঁরা তৈরি করতে চান একটি প্যারোডি ব্র্যান্ড। যেখানে নায়ক মোদীজি নন, উনিজি।
সুমনের ব্যাখ্যা, ‘সমালোচনাতেও যদি মোদী বা মোদীজি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করি, তা হলেও আখেরে তা মোদীরই প্রচার হয়ে দাঁড়ায়। এখন উনিজি শব্দটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, সরাসরি নাম করে প্রচার এড়ানো যাচ্ছে। কাজ হয়ে যাচ্ছে উনিজি বললেই।’ বিজেপি-মোদীর কড়া সমালোচক, ফেসবুক লেখক সায়ন্তন চক্রবর্তী বলছেন, ‘জর্জ অরওয়েলের উপন্যাসে যেমন ভয়ে কেউ বিগ ব্রাদারের নাম উল্লেখ করত না, তেমনই এক ভয়ের রাজত্বে আমরা রয়েছি। যেখানে উনিজি আসলে মোদীজিই! কিন্তু সরাসরি নাম বলা বারণ!’
সমালোচকদের উদ্দেশ্য কটাক্ষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হলেও ভাষাবিদ পবিত্র সরকার মনে করেন, উনিজি শব্দের মাধ্যমে আসলে সম্মান প্রদর্শনই হচ্ছে। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘ইনি-উনি জাতীয় শব্দকে আমরা বলি মানী-সর্বনাম। অর্থাৎ, মান-সম্মান আছে, এমন কারও ক্ষেত্রে এই ধরনের সর্বনাম প্রয়োগ করা যায়। ইনি হলে কাছের, উনি হলে খানিকটা দূরের মানুষ। ইংরেজিতে এই ধরনের সর্বনাম ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফরাসিতে আছে। বাংলা, হিন্দি-সহ একাধিক ভারতীয় ভাষায় এ ধরনের শব্দ ব্যবহারের চল রয়েছে।’
এই সম্বোধনকে গেরুয়া শিবির কী ভাবে দেখছে? বিজেপি নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা মনে করিয়ে দিচ্ছেন অন্য একটি শব্দবন্ধের কথা। যার প্রচলনের নেপথ্যে বিজেপির বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করেন তিনি। শঙ্কুদেবের কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাননীয়া সম্বোধনের মাধ্যমে যে সম্মানজনক ব্যঙ্গ রয়েছে, এটা তারই কাউন্টার। উনি বলুন, ইনি বলুন আর যা-ই বলুন, মোদীজিকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।’