অনির্বাণ ঘোষকম বয়সে, অর্থাৎ কৈশোরে কিংবা বয়ঃসন্ধিতে ধূমপান শুরু করলেই শুধু বড় হয়ে ডায়াবিটিসের ঝুঁকি বাড়ে না। গর্ভবতী মায়ের যদি ধূমপানের অভ্যাস থাকে কিংবা তিনি যদি নিয়মিত প্যাসিভ স্মোকিংয়ের শিকার হন, সে ক্ষেত্রেও মাতৃগর্ভেই শিশুর বড় হয়ে ডায়াবিটিসের আশঙ্কা তৈরি হয়। কেননা, এই ঝুঁকির বীজ বপন হয়ে যায় শিশুর ভ্রূণাবস্থাতেই। সম্প্রতি একটি চিনা গবেষণাপত্রে চাঞ্চল্যকর এই দাবি করা হয়েছে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের একটি সায়েন্টিফিক সেশনে। ফলে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে স্বাস্থ্য মহলে।
সারা দুনিয়াতেই কমবেশি বেড়ে চলেছে কৈশোরে ধূমপান শুরুর প্রবণতা। মহিলাদের ধূমপানের অভ্যাসও ঊর্ধ্বগামী। ভারত কিংবা বাংলাতেও পুরুষদের পাশাপাশি কিশোর-কিশোরী-মহিলাদের সিগারেট-বিড়ি খাওয়ার এই প্রবণতায় কোনও ব্যতিক্রম ধরা পড়েনি। বরং ২০২১ সালের কেন্দ্রীয় সমীক্ষা পঞ্চম ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্টের পাশাপাশি গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের রিপোর্টও বলছে, কিশোর-কিশোরী-মহিলাদের মধ্যে যেমন বেড়েছে ধূমপানের অভ্যাস, তেমনই বেড়েছে প্যাসিভ স্মোকিংয়ের ঘটনাও।
ফলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ দেশ যে ক্রমেই বিশ্বের ডায়াবিটিস রাজধানী হয়ে উঠছে, তার নেপথ্যে বিরাট ভূমিকা রয়েছে ধূমপানেরও। চিনের সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটির দুই গবেষক জ়ুয়ানওয়েই জিয়াং ও ভিক্টর ডব্লিউ ঝংয়ের লেখা যে গবেষণাপত্রটি গত সপ্তাহে পড়ে শোনানো হয়েছে শিকাগোয় আয়োজিত আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের এপিডেমিয়োলজি অ্যান্ড প্রিভেনশন সায়েন্টিফিক সেশনে, তাতেও উঠে এসেছে এই ঊর্ধ্বগামী ধূমপান নিয়ে উদ্বেগের কথা।
কেননা, ইউকে বায়োব্যাঙ্কের ডেটাবেসে থাকা ৪ লক্ষ ৭৬ হাজার মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জীবনপঞ্জী গত দেড় দশক ধরে বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেছেন, শৈশব কিংবা বয়ঃসন্ধি, এমনকী ভ্রূণাবস্থাও ধূমপানের কবলে যদি পড়ে, তা হলেই ভবিষ্যতে তৈরি হয় টাইপ-টু ডায়াবিটিসের ঝুঁকি। অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়সে শরীরে দেখা যায় ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স। তখন শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপন্ন হলেও তা আর কোষস্তরে কাজ করে উঠতে পারে না। ফলে বেড়ে যায় ব্লাডসুগার লেভেল। আর এখানেই ডায়াবিটিস বিস্ফোরণের আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন ভারতীয় চিকিৎসকরা।
কারণ, দেখা গিয়েছে, দেশের ১০.৭% এবং বাংলার ১৬.৭% মানুষ ধূমপান করলেও, পরোক্ষ ধূমপান বা প্যাসিভ স্মোকিংয়ের বহর এর চেয়ে ঢের বেশি। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, এ দেশে ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন যথাক্রমে ৩৮.৭% ও ৩০.২% মানুষ। বলাই বাহুল্য, এর অধিকাংশই মহিলা। আর প্রত্যক্ষ ধূমপান তো রয়েছেই। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্ট বলছে, গড়ে ১৫ বছর বয়সে ধূমপান ধরে ৩৮% কিশোর ও ৯% কিশোরী। এবং এই প্রবণতা শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি।
ফলে গর্ভবতী মায়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান যে গর্ভস্থ ভ্রূণকে আগামী দিনে ডায়াবিটিসে ভোগার দিকে ঠেলে দিচ্ছেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, জিয়াও টং ইউনিভার্সিটির গবেষণাটিতে দাবি করা হয়েছে, যারা কখনোই ধূমপান করেন না, তাঁদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ডায়াবিটিস হওয়ার হার বেশি। এবং সেই হার আরও বেশি, যারা ধূমপান শুরু করেছিল কৈশোর কিংবা বয়ঃসন্ধিতে অথবা ভ্রূণাবস্থায় তাদের মা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান করেছেন জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে।
ফিটাল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ভ্রূণাবস্থায় পরিবেশের প্রভাবে নানা জিনগত পরিবর্তনের নজির নতুন নয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে। সেই এপিজেনেটিক চেঞ্জের নেপথ্যে যে ধূমপানও থাকবে, সেটাও অজানা নয়। কিন্তু যে ভাবে এই গবেষকরা ধূমপানের প্রভাব সমীক্ষার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, তা প্রশংসনীয় এবং সকলের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞ সতীনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ধূমপান প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়া আখেরে শরীরে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহের জন্ম দেয়। এই ধোঁয়া সাইটোকাইন হরমোনকে অতিসক্রিয় করে তোলে। ফলে শরীরে সব সময়েই একটা লঘু মাত্রার কিন্তু ক্রনিক ইনফ্লামেশন হতে থাকে। সেটাই পরে ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্সের জন্ম দেয়। তখনই হয় টাইপ-টু ডায়াবিটিস। তাই ধূমপানে সব সময়েই পরে ডায়াবিটিসের ঝুঁকি বেশি।’