চোখের সামনে সুদীপ্তর মর্মান্তিক মৃত্যু, সেই শপথেই লড়াই সৃজন-প্রতিকুরদের
২৪ ঘন্টা | ০৩ এপ্রিল ২০২৪
অনুষ্টুপ রায় বর্মণ: ‘যতই ঝড়জল হোক, বাম রাজনীতির কাজ থেকে সে সরে আসবে না কিছুতেই, কখনো’। আরেকটা ২ এপ্রিলের আগে ফেসবুকে দৃপ্ত ঘোষণা যাদবপুরের বামপ্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যের।এই শপথ যে ঘটনার পরে নেওয়া সেই ঘটনার পরে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় এক যুগ। কিন্তু এখনও রাজ্যবাসীর স্মৃতিতে দগদগে ১১ বছর আগের সেই মৃত্যু। নেতাজি নগর কলেজের জিএস থেকে বাম ছাত্র আন্দোলনের রাজ্যস্তরের নেতা সুদীপ্তর শেষ মিছিল ছিল এই ২ এপ্রিল।
কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মিছিল করার সময় ছাত্রকর্মীদের গ্রেফতার করে পুলিস। এসএফআই এর তরফে অভিযোগ ওঠে তাদের কে নিয়ে যাওয়ার সময়ে পুলিস সুদীপ্তর মাথায় বারবার আঘাত করে।ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখা যায় যে সুদীপ্তর চোয়াল ভাঙা এবং মাথা ফাটা ছিল এবং সেই সঙ্গে তাঁর সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।ময়নাতদন্তের রিপোর্টের তীব্র বিরোধিতা করে কলকাতা পুলিস। পুলিস বলেছিল যে সুদীপ্তর মাথায় যে আঘাত লেগেছে তা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি একটি ভোঁতা, স্থির বস্তুতে ধাক্কা খেয়েছিলেন। জাভেদ শামিম, তৎকালীন যুগ্ম পুলিস কমিশনার, আইন ও শৃঙ্খলা, কলকাতা, বলেন, ‘মাথায় আঘাতের কারণে মৃত্যু... এবং লাঠি বা রডের কারণে কোনও আঘাত নেই... ল্যাম্পপোস্টে মাথায় আঘাত লেগেছিল’।মুখ্যমন্ত্রী পুলিসের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, সুদীপ্ত বাস থেকে পড়ে যাওয়ার সময় একটি ল্যাম্পপোস্টে তার মাথায় আঘাত লেগেছিল। গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই বাসে।২ এপ্রিল ২০২৪। শুরু হয়ে গিয়েছে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ। এই পারদ বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে লোকসভা ভোটের উত্তাপ। এই নির্বাচনে বামেদের প্রার্থী তালিকায় উজ্জ্বল উপস্থিতি সেই সময়ে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী এবং পরবর্তীকালে বাম ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা সৃজন ভট্টাচার্যের। উঠে আসছে বাম ছাত্র আন্দোলনের আরেক নেতৃত্ব প্রতিকুর রহমানের নামও। যদিও এখনও সেই নামে কোনও সিলমোহর পরেনি।এই সময়কালে ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান নেতৃত্ব দেবাঞ্জন-প্রণয়দের নেতৃত্বে ‘সুদীপ্ত শপথের মিছিল’-এ দেখা গেল দু’জনেরই উপস্থিতি। টালিগঞ্জ মেট্রো থেকে নেতাজিনগর মোড় অবধি মিছিলে পা মেলালেন দু’জনেই। এই মিছিলের রুট ছিল যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অলিগলি দিয়ে সুদীপ্তর রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে। পাশাপাশি সৃজনের ফেসবুকের স্মৃতিচারণেও উঠে এল সুদীপ্তর কথা। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘যখন বড় হচ্ছি, স্বজনদের কারো ইচ্ছে, ছেলে উকিল হবে। কারো ইচ্ছে শিক্ষকতা করবে, কেউ আবার বলছে ডাক্তারিটাই পড়ুক। যা হয় আর কী বয়ঃসন্ধিকালে। এই ভবিষ্যতের রাস্তা ঠিক করতে পারা না পারার দোলাচলে থাকা সেকেন্ড ইয়ারের আমি'কে ২রা এপ্রিল, ২০১৩ এক লহমায় জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলিয়েছিল অক্লেশেই। রাত ১০টার পর, পিজি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে, বাড়ি ফেরার রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে শহীদ সুদীপ্ত গুপ্ত'র জুনিয়র নিজেই নিজেকে কথা দিয়ে ফেলেছিল, যতই ঝড়জল হোক, বাম রাজনীতির কাজ থেকে সে সরে আসবে না কিছুতেই, কখনো।’ সেই মিছিলের এক মুখ ডায়মন্ড হারবার লোকসভা আসনের সম্ভাব্য সিপিআইএম প্রার্থী প্রতীক জানালেন, 'ঘটনাচক্রে সুদীপ্তর মৃত্যুর পুরো ঘটনার সাক্ষী আমি। আমার চোখের সামনে সেই ঘটনা ঘটেছিল। সুদীপ্ত যে আদর্শের জন্য লড়াই করছিল সেটা ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। সেই লড়াই আজও চলছে। সেই সময়ের থেকে বদলেছে একটাই, আজ দেশ এবং রাজ্য দুই জায়গাতেই গণতন্ত্র নেই। আজ মিছিল আছে, সুদীপ্ত নেই। সুদীপ্তর ছবি আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভেবেছিলেন সুদীপ্তকে খুন করে তিনি ছাত্র আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি আজ প্রমাণিত। আলাদা কোনও ইমোশন নয় কিন্তু আমার গর্ব হয় যে আমি সেই রাজনীতি করি যার জন্য সুদীপ্ত, সৈফুদ্দিন নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে'।২ এপ্রিল সকাল থেকেই ফেসবুকে একটা ছবি ঘুরছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মিছিলের ছবি যেখানে পাশাপাশি সুদীপ্ত এবং সৃজন। সুদীপ্তর স্লোগানে গলা মেলাচ্ছে আজকের বাম প্রার্থী। সুদীপ্তকে এই লড়াইয়ে হারিয়েছে তাঁর সাথীরা। কিন্তু এই হারানোর শোক তাঁদেরকে পিছনে না টেনে আরও এগিয়ে যাওয়ার রসদ দিয়েছে বলেই মনে করে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা।সুদীপ্ত, স্বপন, সৈফুদ্দিনের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যারা কাঁধে তুলে নিয়েছে, মানুষ তাদেরকে সংসদের অলিন্দে পৌঁছানোর সুযোগ দেবে কিনা তা সময় বলবে। কিন্তু লড়াই যে জারি রয়েছে যা বুঝিয়ে দিচ্ছেন দু’জনেই।