এই সময়: খেতে পেলে অনেকেই শুতে চায়। আর একবার একটা এসইউভি যৌতুকে কনের বাড়ি থেকে পেয়ে গেলে তার পর টয়োটা ফরচুনার চায় পাত্রের বাড়ির লোকজন। তা না-দিতে পারলে? কাউকে কাউকে শেষ করে দেওয়া হয়। করিশমার মতো। গ্রেটার নয়ডার করিশমা। শুধু তো পণের দাবি নয়। তিনি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে ‘অপরাধ’ করেছেন বলেও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার চরমে উঠেছিল।সে জন্য নগদ ১০ লক্ষ টাকা ‘জরিমানা’ দিতে হয় করিশমার বাপের বাড়ির তরফে। তার পরেও অত্যাচার থামেনি। কারণ, তখন নতুন দাবি। শ্বশুরবাড়ি বলল, তাদের চাই টয়োটা ফরচুনার। যার বেসিক মডেলই শুরু হচ্ছে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা থেকে। সেই সঙ্গে নগদ আরও ২১ লক্ষ টাকার দাবি!
গ্রেটার নয়ডার ইকোটেক থ্রি-র খেদা চৌগনপুর গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে গত শুক্রবার, ২৯ মার্চ করিশমাকে মৃত অবস্থায় পান তাঁর ভাই দীপক। মৃতার ভাই ওই যুবক তাঁর বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে পণের দাবিতে করিশমাকে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগ দায়ের করেছেন ইকোটেক-থ্রি থানায়।
সেই অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার করিশমার স্বামী বিকাশ ভাটি ওরফে বিট্টু ও তার বাবা সোমপাল ভাটিকে পুলিশ ইকোটেক থ্রি এলাকার একটি সার্ভিস রোড থেকে গ্রেপ্তার করেছে। গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশকের অন্তত মাঝামাঝি পর্যন্ত সাড়া ফেলে দেওয়া একটি বাংলা নিউজ় ম্যাগাজ়িনের প্রথম সংখ্যার কভার স্টোরির শিরোনাম ছিল— ‘পণ দেবো না, পণ নেব না।’
সেটা ১৯৭৮-এর ১ জুলাই। মারকাটারি হিট হয়েছিল ম্যাগাজ়িনের সেই সংখ্যা। কিন্তু তার সাড়ে চার দশক পরেও পণের চিত্রটা এ দেশে কী, তার টাটকা উদাহরণ করিশমার হত্যা। পুলিশ জেনেছে, ২০২২-এর ডিসেম্বরে বিকাশের সঙ্গে করিশমার বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়ির চাহিদা মেনে নিয়ে বিয়ের সময়ে বরপণ বাবদ দেওয়া হয়েছিল ১১ লক্ষ টাকার গয়না এবং একটি গাড়ি। যেমন-তেমন গাড়ি নয়, এসইউভি।
স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল। কিন্তু করিশমার শ্বশুরবাড়ির আশ তাতে মিটল না। একবার কনের বাপের বাড়ি পাত্রের বাড়ির দাবি মতো যৌতুক দিতে রাজি হলে এবং দিয়ে দিলে যেমন আগল খুলে যায়, এ ক্ষেত্রে সেটাই হলো। বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে নগদে ও সামগ্রীতে আরও, আরও পণ এনে দিতে চাপ বাড়তে লাগল ওই তরুণীর উপর এবং চাপ থেকে অত্যাচার— শারীরিক ও মানসিক। এরই মধ্যে ওই তরুণী জন্ম দিলেন এক কন্যাসন্তানের।
একে তো অতিরিক্ত পণ আসছে না, তার উপর পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারল না বাড়ির বৌ? সেই ‘অপরাধে’ অত্যাচার বাড়ল বহু গুণ। অসহনীয় উঠল পরিস্থিতি। এতটাই যে, বিকাশের গ্রামে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে বেশ কয়েক বার মিটিং বসল। শেষমেশ করিশমার বাপের বাড়ি থেকে তাঁর শ্বশুরবাড়িকে দেওয়া হলো নগদ ১০ লক্ষ টাকা। করিশার বাড়ির লোকজন আশা করলেন যে, এ বার অত্যাচার বন্ধ হবে।
কিন্তু কোথায় কী! নিপীড়ন থামল না। এ বার নতুন দাবিতে। টয়োটা ফরচুনার চাই এবং নগদ চাই ২১ লক্ষ টাকা। সেই দাবি না-মেটায় ফের মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। তার পর এল সব কিছু শেষ হওয়ার দিন, ২৯ মার্চ। বোনকে হারানো দাদা দীপকের কথায়, ‘গত শুক্রবার বোন আমাদের বাড়িতে ফোন করেছিল। ও তখন কাঁদছে। বলছে, আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’
দীপক বলেন, ‘ওর স্বামী বিকাশ, বিকাশের মা-বাবা আর ভাই-বোনরা সবাই মিলে ওকে বেধড়ক মারধর করছে।’ ওই ফোন পেয়ে দীপক ও অন্যেরা ছুটে গেলেন খেদা চৌগনপুর গ্রামে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য, ‘গত ২৯ মার্চ আমরা খবর পাই যে, এক তরুণীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁর বাপের বাড়ির লোকজনের কাছে অতিরিক্ত পণের দাবি করেছিল। সেই দাবি না-মেটায় ওই তরুণীর উপর অত্যাচার চলছিল এবং শেষমেশ তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তদন্ত শুরু হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করছি।’
পুলিশ জানিয়েছে, ওই মামলায় বিকাশের মা, বোন এবং তার দুই ভাইও অভিযুক্ত। ওই চার জনের খোঁজ চলছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা।আর দীপক? যিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েও বোনকে বাঁচাতে পারেননি? তিনি এখন থেকেই থেকেই শুনতে পাচ্ছেন করিশমার বলা শেষ কথাগুলো— ‘আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’