পায়ের নীচে বিপুল জলভাণ্ডার! জীবন কি লুকিয়ে পৃথিবীর গর্ভে
এই সময় | ০৪ এপ্রিল ২০২৪
এই সময়: এ যেন জুলে ভার্নের লেখা কোনও কল্পবিজ্ঞানের গল্প! তবে গল্প হলেও সত্যি... ক্রমশ ফুরিয়ে আসা জল নিয়ে যখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ, ঠিক তখনই মাটির অন্তত ৭০০ কিলোমিটার নীচে বিপুল জলভাণ্ডারের সন্ধান মিলেছে বলে দাবি করলেন একদল গবেষক। তাঁদের বক্তব্য, ভূপৃষ্ঠে সব মহাসাগর মিলিয়ে যে পরিমাণ জল রয়েছে, এই জলভাণ্ডার তার থেকে অন্তত তিন গুণ বেশি। এই জল ব্যবহারযোগ্য কি না, সুইট না স্যালাইন— সে সব প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা।
তবে এখানেই এই গবেষণার গুরুত্বে দাঁড়ি পড়ছে না। পৃথিবীতে কী ভাবে সমুদ্রের সৃষ্টি হলো, কী ভাবে এল এই বিশাল লবণাক্ত জলরাশি— তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলেছে। মোটামুটি যে সব তত্ত্বে মান্যতা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো মেলটেড কমেটস থিয়োরি (গ্রাফিক্স দ্রষ্টব্য)। যার মূল কথা, ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়া ধূমকেতুর বরফ গলে সমুদ্রের সৃষ্টি হয়েছিল।তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, এই তত্ত্বই কিন্তু এখন বড়সড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গেল। কেননা, এই সুবিশাল রিজ়ার্ভারের সন্ধান মেলার পরে গবেষকদের একাংশের প্রশ্ন, তা হলে কি পৃথিবী নিজের গর্ভেই ধারণ করে রেখেছিল তার ‘জীবন’? এই তত্ত্ব যদিও নতুন নয়, তবে মেলটেড কমেট থিয়োরির তুলনায় পিছিয়ে ছিল। কারণ, এর পক্ষে তেমন কোনও জোরালো যুক্তি এত দিন দেখানো যায়নি বলে গবেষকদের একাংশের বক্তব্য। তাঁরা বলছেন, এ বার সেই যুক্তির পালেও জোরালো হাওয়া লাগল।
কাদের গবেষণা? কীসের গবেষণা?
ইউএসএ-র ইভানস্টনের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এই ওয়াটার রিজ়ার্ভারের সন্ধান পেয়েছেন। ‘ডিহাইড্রেশন মেল্টিং অ্যাট দ্য টপ অফ দ্য লোয়ার ম্যান্টল’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে এই জলভাণ্ডারের কথা বলা হয়েছে। মহাসাগরগুলির সৃষ্টির শিকড় খুঁজতে গবেষণা শুরু হয়েছিল। যার ফলাফল চমকে দিয়েছে গোটা দুনিয়াকে।
কোথায়, কী ভাবে রয়েছে রিজ়ার্ভার?
গবেষকদের বক্তব্য, ভূপৃষ্ঠ থেকে মোটামুটি ৭০০ কিলোমিটার নীচে এই জল থাকার সম্ভাবনা প্রবল। ভূগর্ভে ওই এলাকায় (ট্রানজ়িশন জ়োন) রিংউডাইট নামে এক ধরনের নীল রঙের পাথর পাওয়া যায়। সেই পাথরই ধরে রেখেছে এই জল। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, রিংউডাইট হলো অনেকটা স্পঞ্জের মতো, জল-ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। কী ভাবে এই পাথর জল-ধারণ করে? গবেষকদের বক্তব্য, রিংউডাইটের যে ক্রিস্টাল স্ট্রাকচার (অ্যাটমের এক বিশেষ বিন্যাস) রয়েছে, তা অদ্ভুত। এই ক্রিস্টাল স্ট্রাকচারই হাইড্রোজেনকে আকর্ষণ করে এবং জল ট্র্যাপ করে রাখে।
কতটা জল রয়েছে?
পৃথিবীর সব মহাসাগরের অন্তত তিন গুণ বেশি জল সঞ্চিত রয়েছে এই রিজ়ার্ভারে। এই গবেষণার অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী স্টিভেন জেকবসনের অনুমান, এই পুরো জলরাশি যদি উপরে উঠে আসে, তা হলে মাটি বলতে যেটুকু দেখা যেতে পারে, তা হলো মাউন্ট এভারেস্ট-সহ পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি পর্বত শিখরের একেবারে উপরের অংশটুকু। তা-ও হবে কি না সন্দেহ।
কী ভাবে মিলল সন্ধান?
ইউএসএ-জুড়ে ২০০০ সিসমোগ্রাফ ব্যবহার করেছিলেন গবেষকরা। এই সিসমোগ্রাফে ক্যাপচার করা ৫০০টি ভূমিকম্পের সিসমিক ওয়েভ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা যায়, পৃথিবীর কোর (CORE) সমেত সবক’টি ইনার লেয়ার বা ভিতরের স্তর দিয়ে যে সিসমিক তরঙ্গগুলি গিয়েছে, একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তাদের গতি শ্লথ হয়ে পড়ছে। কেন এমনটা হচ্ছে, তা খুঁজতে গিয়েই মেলে এই বিপুল জলের সন্ধান। গবেষকদের বক্তব্য, জল থাকার কারণেই তরঙ্গগুলির গতি কমে যায়।
মহাসাগর-তত্ত্ব বদলের সম্ভাবনা উঠছে কেন?
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের দাবি, রিংউডাইট লাগাতার হাইড্রোজেনকে আকর্ষণ করতে থাকে। এই প্রক্রিয়া সদ্য শুরু হয়েছে, এমন মোটেই নয়। পৃথিবী তৈরির কোনও না কোনও একটা সময়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এবং তা এখনও চলছে। তাই পৃথিবী তৈরির সময়ে এই জল ম্যান্টলের বিভিন্ন স্তর চুঁইয়ে কখনও উপরে উঠে আসেনি, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
প্রমাণ মিলেছিল আগেও? ২০১৪ সালে ক্যানাডার ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালবার্টার গবেষণায় মাটির নীচের জলের এমন ভাণ্ডারের ইঙ্গিত মিলেছিল। একটি আগ্নেয়গিরি দিয়ে বেরিয়ে আসা ট্রানজ়িশন জ়োনের একটি হিরে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাতে জল ধরে রাখা রিংউডাইট পাওয়া যায়। তবে সেটুকু প্রমাণের ভিত্তিতে বিপুল জলের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এবার সেই ফাঁক অনেকটা পূরণ হলো বলে দাবি গবেষকদের একাংশের।