হাওড়ায় মেট্রো রেল চালু করতে গিয়ে স্তব্ধ শৈলেন মান্না স্টেডিয়ামের খেলা
এই সময় | ০৪ এপ্রিল ২০২৪
হাওড়া শহরের গর্বের মুকুটে নতুন পালক হিসেবে সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে মেট্রো রেল। কয়েক সপ্তাহ আগেই হাওড়া ময়দান থেকে হাওড়া স্টেশন হয়ে গঙ্গার নীচে নিয়ে মহাকরণ ছুঁয়ে মেট্রো প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীকে পৌঁছে দিচ্ছে এসপ্ল্যানেডে।এই পালক সংযোজন হতে গিয়ে কিন্তু হাওড়া ময়দান থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে শুধু হাওড়া নয়, এই রাজ্যের অন্যতম গর্বের একটি ফুটবল স্টেডিয়াম। মেট্রোর কাজের জন্য শৈলেন মান্না স্টেডিয়ামের ৩০ মিটার জমি অধিগ্রহণ করেছিল কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন অর্থাৎ কেএমআরসি।
২০১৪ সালে সেই জমি নেওয়ার সময় স্টেডিয়ামের দায়িত্বে থাকা হাওড়া কর্পোরেশনকে বলা হয়েছিল, তিন বছরের মধ্যে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তারপরে খেলার মাঠের পশ্চিম প্রান্ত বরাবার তুলে দেওয়া হয়েছিল একটি সুদীর্ঘ কংক্রিটের পাঁচিল।
এই পাঁচিল হওয়ার পরে মাঠের মাপ এতটাই ছোট হয়ে যায়, যে এখানে জাতীয় পর্যায়ের তো বটেই কলকাতা লিগেরও ভালো ম্যাচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর তিনের বদলে ১০ বছর অতিক্রান্ত। শৈলেন মান্না স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকার কাজ বহুদিন আগে শেষ হয়ে গেলেও সেটা কার্যত এখন আবর্জনার স্তুপ হয়ে পড়ে আছে।
পাঁচিল বেয়ে আগাছার জঙ্গল। ঢিল ছোড়া দূরে হাওড়া ময়দান মেট্রো স্টেশন যখন আলো ছড়াচ্ছে, তখন শৈলেন মান্না স্টেডিয়াম কার্যত খেলাধুলোহীন হয়ে পড়ে আছে অন্ধকারে। মেট্রো কবে জমি ফেরাবে? বুধবার সকালে হাওড়া কর্পোরেশনের প্রশাসক মন্ডলীর চেয়ারপার্সন সুজয় চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘এই স্টেডিয়াম আমাদের গর্ব। এখানে অনেক কিছু করার স্বপ্ন রয়েছে আমাদের। আমি নিজে বহুবার কেএমআরসি-র শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জমি ফেরত চেয়েছি। কিন্তু ওঁরা ব্যাপারটা ঝুলিয়েই রেখেছেন।’
এ দিন বিকেলে অবশ্য কলকাতা মেট্রো রেলের সিপিআরও কৌশিক মিত্র বললেন, ‘আমরা এই জমি ফিরিয়ে দিয়েছি সংশ্লিষ্ট সংস্থার হাতে।’ এর মধ্যে আবার হাওড়ার সাংসদ, যিনি দেশের একমাত্র ফুটবলার সাংসদ, সেই প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘আমি নিজে এ ব্যাপারে রেলওয়ে অথরিটির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ওঁরা বলেছিলেন, মেট্রো চালু হয়ে গেলেই মাঠের জমি ফেরাবেন। শুনছি ওঁরা তা করেননি এখনও। আমি এবার জিতলে ফের পার্লামেন্টে এ নিয়ে সরব হব।’
কয়েক দশক ধরে হাওড়ার এই স্টেডিয়ামই সারা রাজ্যকে আলোকিত করেছিল। সাড়ে ছয় একর জমির উপর তৈরি এই স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক তকমা পেয়েছিল ২০০৬ সালে। ইউথ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলের বেশ কয়েকটা ম্যাচ এখানে হয়েছিল। যার মধ্যে কির্ঘিস্তান বনাম জর্ডন আর অস্ট্রেলিয়া বনাম সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর রোমাঞ্চকর ম্যাচ দুটো আজও মনে আছে ফুটবলপ্রেমীদের।
এই মাঠে মোহনবাগান তাদের এএফসি কাপের গ্রুপ লিগের একাধিক হোম ম্যাচ খেলেছিল কাতার, জর্ডনের ক্লাবের বিরুদ্ধে। জার্মানির কিংবদন্তি ফুটবলার গার্ড মুলার এই মাঠে এসে ছোটদের নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে একটা ফুটবল কোচিং ক্যাম্প করার পরে বলেছিলেন, ‘কলকাতায় এসে যে ক-টা মাঠে ঘুরলাম, তার মধ্যে হাওড়ার এই মাঠটাই সেরা।’
ফুটবল খেলার জন্য মাঠের যেটা প্রমাণ সাইজ অর্থাৎ ১১০ মিটার লম্বা ও ৬৫ মিটার চওড়া, তা হাওড়া মাঠের ছিল। আর ছিল সবুজ মখমলের মতো ঘাস। মাঠের নীচে দিয়ে সাতটি ড্রেনেজ লাইন করে জল বেরোনোর পথ থাকায় সারা রাজ্যের মাঠে বৃষ্টিতে খেলা ভেস্তে গেলেও হাওড়া মাঠে ঠিক খেলা হয়ে যেত।
১৯৯২ সালের ৩১ অগস্ট তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করেছিলেন। তখন ওই স্টেডিয়ামের নাম হয়, হাওড়া কর্পোরেশন স্টেডিয়াম। ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্যালারির সম্প্রসার করে ১৫ হাজার দর্শকাসনের সঙ্গে অত্যাধুনিক ড্রেসিংরুম ও মিডিয়া রুম বানিয়ে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় জেলার কিংবদন্তি ফুটবলার প্রয়াত শৈলেন মান্নার নামে।
ঠিক হয়, দ্রুত ফ্লাডলাইট বসিয়ে এখানে নিয়মিত মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের ম্যাচ করানো ও জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টের আয়োজন করা। কিন্তু তারই মধ্যে মেট্রো মাঠের জমি নিয়ে নেয়। তারপরে যাবতীয় বড় খেলা আটকে যায়। সেটা কবে ফের চালু হবে এখন সেটাই বড় প্রশ্ন।