অর্ণব আইচ: খুনের পর ভাইয়ের স্ত্রীর খন্ডিত দেহ সাইকেল করে পাচার করেছিল ওয়াটগঞ্জের নীলাঞ্জন। মোট দু’দফায় সাইকেলে সাদা ব্যাগে কালো পলিথিনে মোড়া দেহ ঝুলিয়ে নেয়। মোট তিন জায়গায় দেহের অংশ পাচার করে বাড়িতে ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। ঘুম থেকে উঠে নিহত মহিলা দুর্গা সরখেলের বাপের বাড়িতে গিয়ে বলে, সারা রাত ধরে বাড়িতে ফেরেননি বাড়ির বউ। দুর্গার দেহ শনাক্তকরণের পর পরিবারের লোকেদের দেওয়া ‘নিখোঁজ’-এর তথ্যই পুলিশের মধ্যে সন্দেহ জাগায়। ওয়াটগঞ্জ থানায় সারারাত ভাসুর নীলাঞ্জনকে পুলিশ জেরা করে। উল্লেখ্য, ভাইয়ের স্ত্রীকে খুন ও দেহ ন’খণ্ড করে পাচারের অভিযোগে ভাসুর শুদ্ধ নীলাঞ্জন সরখেলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধৃতর দাবি, ‘রাগের বশে’ সে খুন করেছে। যদিও এই ঘটনার পিছনে তন্ত্রসাধনা ও নরবলি রয়েছে কি না, সেই তথ্যও পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
পুলিশের সন্দেহ, দুর্গার স্বামী ধনধারী সরখেল এক বছর ধরে নেশামুক্তি কেন্দ্রে থাকার সময় দুর্গার উপর যৌন নির্যাতন চালাত ৫৫ বছর বয়সের নীলাঞ্জন। তার সঙ্গে চলত মারধরও। গত সোমবার সকাল দশটা নাগাদ নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে ওয়াটগঞ্জের হেমচন্দ্র স্ট্রিটের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় দুর্গার স্বামী। কিন্তু ফের নেশা করার জন্য তাঁর ভাই নীলাঞ্জনের পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা চুরি করে পশ্চিম বন্দর এলাকার নমক মহল রোডে শ্বশুরবাড়িতে পালিয়ে যান। সেখান থেকেই গোলমালের শুরু। নীলাঞ্জন দুর্গার উপর প্রচণ্ড অত্যাচার করে। পুলিশের ধারণা, দুর্গা সোমবার সেই টাকা ফেরত দিলেও টানা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁর উপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কথা স্বামী ও অন্যদের ফাঁস করে দেবেন বলেন। এমনকী, মহিলার পেট থেকে নিম্নাঙ্গের অংশ উদ্ধার না হওয়ার ফলে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন, এমন সম্ভাবনাও পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছে না। রাতেই সে দুর্গাকে গলা কেটে খুন করে। তবে নিজেকে তন্ত্রসাধক বলে দাবি করা শুদ্ধ নীলাঞ্জন তন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে দুর্গাকে মদ্যপান করিয়ে নরবলি দেওয়ার নাম করে তাঁর গলা কেটে ফেলে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে।
বছর দুই আগে সরখেল পরিবারের বড় মেয়ে রেলের চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর ওয়াটগঞ্জের বাড়ির দোতলাটি কেনেন। সেখানেই থাকতে শুরু করে বাকিরা। ধনধারী ও দুর্গার ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র। বাড়িতে দুর্গার ভাসুর নীলাঞ্জন ছাড়াও থাকেন বৃদ্ধা ও অথর্ব মা, মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত বোন। মা রেলের পেনশন পান। দুর্গার স্বামী ধনধারী রেলের চাকুরে হলেও থাকতেন রিহ্যাবে। বেকার নীলাঞ্জন তন্ত্রসাধনা করেই দিন কাটাত। বাড়ির ‘কর্তা’ হিসাবে সারাদিন দুর্গাকে দিয়ে সব কাজ করাত। তার উপর জানালা বন্ধ করে চলত অত্যাচার। প্রতিবেশীরা শুনতে পেতেন দুর্গার কান্না। সোমবার দুর্গার স্বামী টাকা চুরি করে পালানোর পর বাপের বাড়িতে যান দুর্গা। তাঁর ভাই রাত দশটা নাগাদ বাইকে করে দিদিকে পশ্চিম বন্দরে বাপের বাড়ি থেকে ওয়াটগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেন। টাকা ফেরত দিলেও অত্যাচারের পর চলে হুমকি, পাল্টা হুমকি। খুনের ছক কষেই দুর্গার ছেলে ও পরিবারের সবাইকে রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মেশায় নীলাঞ্জন। অন্যরা অজ্ঞান হওয়ার পর রাত দু’টোর পর দুর্গাকে জোর করে মদ্যপান করিয়ে গলা কেটে খুন করা হয়। আগে থেকেই জড়ো করা ছিল অস্ত্র।
ঘষে ঘষে কেটে দেহের অংশ আলাদা করা হয়। আগে থেকে জোগাড় করে রাখা ৬টি কালো প্লাস্টিকে ভরা হয় দেহের অংশ। এলাকার দু’টি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছে, প্রথমে ভোর ৪টে ৫৬ মিনিটে বিশুবাবু লেন ধরে সাদা ব্যাগে কালো পলিথিনে পোরা দেহাংশ গিয়ে সাইকেলে করে ফেলে আসে সত্য ডাক্তার রোডের সিআইএসএফ পরিত্যক্ত ব্যারাক চত্ত্বরে। সকাল ৫টা ১৩ মিনিটে পরের দফায় দু’টি ভ্যাটে গিয়ে ফেলে দেয় দেহের অংশ পোরা পলিথিন। সেই অংশগুলি পুরসভার কম্প্যাক্টরে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ওই ভ্যাটগুলিকে চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
সকালে বাড়ি ফিরে সে ঘর মুছে রক্ত পরিষ্কার করে। এর পর নিশ্চিন্তে ঘুমায়। দুপুরে নমকমহল রোডে ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বলে, রাতে দুর্গা বাড়িতে ফেরেননি। হতবাক হয়ে ভাই জানান, তিনি নিজে দিদিকে বাড়ির কাছে বাইকে করে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। মঙ্গলবার দুপুর থেকে বুধবার পর্যন্ত তন্নতন্ন করে দুর্গাকে খুঁজেও না পেয়ে বাপের বাড়ির লোকেরা পশ্চিম বন্দর থানায় মিসিং ডায়েরি করতে গিয়ে দুর্গার খন্ডিত দেহ শনাক্ত করেন। খুনের ‘মোটিভ’ সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে অভিযুক্ত নীলাঞ্জনকে জেরা করা হচ্ছে। পুলিশের ধারণা, খুন ও দেহ খন্ডিত করা হয়েছিল আলাদা অস্ত্রে। সেই অস্ত্রগুলির সন্ধান চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।