অভিযোগ ১ শতাংশ সত্যি হলেও লজ্জার, সন্দেশখালি নিয়ে ক্ষোভ হাইকোর্টের
এই সময় | ০৫ এপ্রিল ২০২৪
এই সময়: সন্দেশখালিতে ইডি অফিসারদের উপর হামলার ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। সেই তদন্ত করতে গিয়ে সেখানে শেখ শাহজাহানের বাহিনীর বিরুদ্ধে জোর করে জমি দখল ও মহিলাদের উপর অত্যাচারের অভিযোগও সামনে এসেছে। আবার সন্দেশখালির ‘বাঘ’ শাহজাহানের দলবলের বিরুদ্ধে ভেড়ির কারবারের নামে কোটি কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় তদন্ত করছে আর এক কেন্দ্রীয় এজেন্সি ইডি।কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেখানে জমি দখল, সেই জমি ফেরানোর প্রক্রিয়া এবং মহিলাদের উপর নিগ্রহের ঘটনাগুলিতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে তদন্তের দাবি জোরালো হলো। বৃহস্পতিবার প্রায় আড়াই ঘণ্টা দীর্ঘ শুনানি করেও রায়দান স্থগিত রেখেছে আদালত।
তবে সেখানে ধারাবাহিকভাবে নারী নিগ্রহ এবং নাগরিকদের জমি দখল করে সেখানে ভেড়ি বানিয়ে কোটি কোটি টাকার চক্র গড়ে তোলার অভিযোগে শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে এতদিন যত মামলা দায়ের হয়েছে এবং যত মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, তার যাবতীয় নথি তলব করল হাইকোর্ট। ওইসব অভিযোগের গভীরতা হাইকোর্ট নিজে খতিয়ে দেখতে চায়। মুখবন্ধ খামে সমস্ত এফআইআর এবং চার্জশিট জমা দিতে হবে রাজ্যকে।
এই শুনানি চলাকালীন এদিন এক নিগৃহীতার তরফে হলফনামা দিয়ে শাহজাহানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে আদালতে। তার বর্ণনা শুনে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করে। আদালতের স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ, এই অভিযোগের এক বর্ণও যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে, এর দায় জেলা প্রশাসন এড়াতে পারে না।
অভিযোগ সত্যি হলে রাজ্য প্রশাসনের জন্য তা লজ্জার। রাজ্যের শাসকদলও এর দায় এড়াতে পারে না। একইসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চের মন্তব্য, ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী এ রাজ্য মহিলারা সবথেকে সুরক্ষিত। এই অবস্থায় যদি সন্দেশখালির একজন মহিলার অভিযোগও এক শতাংশও সত্যি হয়, তাহলে সেটা (রিপোর্টের দাবি) কতটা মিথ্যে, তা স্পষ্ট হবে।’
এদিন ইডি-র তরফেও শাহজাহানের বিরুদ্ধে অতীতে দায়ের যাবতীয় এফআইআরের কপি চাওয়া হয়। হাইকোর্ট জানায়, আগে তারা নিজেরা বিবেচনা করে তারপরেই ওই কপি দেওয়া হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদিও রাজ্য তাদের অবস্থান জানানোর জন্য একটু সময় চায়। আর এক মামলাকারী আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়াল আর্জি জানান, সন্দেশখালির তদন্তে কমিশন গঠন করা হোক।
তাঁর যুক্তি, ‘মহিলারা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। একটা শাহজাহান জেলে আছে, কিন্তু ওখানে এখনও অনেক শাহজাহান আছে।’ এই প্রসঙ্গেই তিনি এক নির্যাতিতার হলফনামা তুলে দেন আদালতের হাতে। তাতে নিগৃহীতার তরফে বলা হয়েছে, কলকাতায় বিয়ে হলেও তাঁর বাপের বাড়ি সন্দেশখালিতে। কিছুদিন আগে তাঁদের জমিজমা দখল হয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে তিনি বাড়ি যান।
শেখ শাহজাহানের দলবল তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে তেরো দিন একটি ঘরে আটরে রেখে লাগাতার শারীরিক নির্যাতন করে। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বামী, বাবা গিয়ে কাউকে কিছু জানানো হবে না—এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। সেই কথা শোনার পরেই কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে হাইকোর্ট।
মামলায় এই দাবিও জানানো হয়েছে, সন্দেশখালির এই ঘটনার সঙ্গে প্রশাসনের সর্বস্তরের আধিকারিকরা যুক্ত আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হোক। এদিন শেখ শাহজাহানের আইনজীবী মক্কেলের পক্ষে সওয়ালের আবেদন করলে আদালতের তোপের মুখে পড়েন।
প্রধান বিচারপতি তীব্র ভর্ৎসনার সুরে বলেন—‘আগে নিজের মক্কেলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ দেখুন, তারপর কথা বলবেন। ৪০-৪৫ দিনের উপর আইনকে এড়িয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। ধর্ষণের একটি অভিযোগও যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটা অত্যন্ত লজ্জাজনক।’
এই মামলায় আদালত বান্ধব জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, মূলত জমি দখল করে কোটি কোটি টাকা কামাইয়ের একটা চক্র সেখানে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন প্রশাসন যেভাবে জমি ফেরাচ্ছে, তা কীভাবে হচ্ছে, সেটাও স্পষ্ট নয়। ভবিষ্যতে এটা আরও বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। মহিলাদের উপরে নির্যাতন নিয়েও তিনি তাঁর রিপোর্ট দেন।
সন্দেশখালি নিয়ে মামলাকারীদের আবেগকে ‘কুমিরের কান্না’ বলে খানিকটা কটাক্ষ করেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত। তাঁর বক্তব্য, ‘যখনই কোনও ঘটনা ঘটে, তখনই জনস্বার্থ মামলার বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু তারপর যখন আদালত থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়, সেই সুবিধা গ্রহণের জন্য খুব কম ব্যক্তিকেই পাওয়া যায়।’ কোনও রিসার্চ না করে এইসব মামলা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাঁর।