প্রশান্ত ঘোষ, ভাঙড় : গত বছর এপ্রিলেও ছবিটা অন্যরকম ছিল। পঞ্চায়েত ভোট উপলক্ষ্যে তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল ভাঙড়ের আইএসএফ নেতা-কর্মীদের মধ্যে। দেওয়াল লেখা, পতাকা লাগানো, পাড়ায় পাড়ায় মিটিং, কোনও কিছুর অভাব ছিল না বিধানসভার দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। একই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হয়েছিল ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও।শুধু ভাঙড় নয়, গোটা রাজ্য কাঁপিয়ে দিয়েছিল সদ্য ডানা মেলা ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। কিন্তু তিন বছর পরে দল বা দলের নেতাদের সেই জোশ কোথায়? গত বেশ কিছুদিন ধরেই এই প্রশ্ন শুধু তৃণমূল নয় আইএসএফের নিচুতলার কর্মীরাও তুলছেন। ভাঙড়ের আইএসএফ কর্মীরা রীতিমত দ্বিধাগ্রস্ত দলের অবস্থান নিয়ে।
বৃহস্পতিবার ডায়মন্ড হারবারে দলের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির না লড়ার সিদ্ধান্তে কার্যত ভেঙে পড়েছেন ভাঙড়ের আইএসএফ কর্মীরা। গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূলের দাপুটে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করা সাধারণ আইএসএফ কর্মীরা শঙ্কিত তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
গত কয়েক মাস ধরেই তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বারবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নওশাদ জানিয়েছিলেন তিনি ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থী হবেন। কিন্তু তার পর ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করার পরেও তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে টালবাহানা করেছেন আইএসএফ নেতৃত্ব। তাঁদের অবস্থানহীনতায় অস্বস্তি বেড়েছে জোটসঙ্গী সিপিএম ও কংগ্রেসের।
অবশেষে বৃহস্পতিবার নওশাদের ভোটে না লড়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসা পর ভাঙড়ের আইএসএফ কর্মী সহিদ মোল্লা বলেন, ‘এতদিন হয়ে গেল নির্বাচন নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেছে কমিশন। আমাদের দল বা নেতারা এত দেরি করলেন নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে!’
তবে এমন কিছু যে হতে চলেছে তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল ভাঙড়ের জল্পনা দেখে। বিধায়ক তথা দলের চেয়ারম্যান নওশাদ সিদ্দিকির নীরবতা নিয়ে নিচুতলার পাশাপাশি স্থানীয় নেতাদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছিল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ভাঙড়ের বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় টানা দশদিন রক্তদান শিবির করেছিলেন নওশাদ।
সেই সময় শিবিরে উপস্থিত হয়ে জনসংযোগের পাশাপাশি কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য ‘টোটকা’ও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর টানা তিনমাস আর নিজের বিধানসভা এলাকায় পা রাখেননি নওশাদ। গত বৃহস্পতিবার হঠাৎই মাঝেরহাট গ্রামে বিধায়ক কার্যালয়ে এসেছিলেন বিধায়ক। কিন্তু তাঁকে ঘিরে কর্মীদের সেই ভিড়, সেই চেনা উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।
পাড়ার মেয়ে-বৌরাও উৎসাহ দেখাননি তাঁদের প্রাণপ্রিয় ‘ভাইজান’কে একঝলক দেখতে আসার। নওশাদ নিজেও খানিকটা চুপচাপ ছিলেন সে দিন। ডায়মন্ড হারবারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হুঙ্কার দিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসায় এলাকায় গুঞ্জন ছড়ায়, ‘তবে কি সেটিং হয়ে গেল তৃণমূলের সঙ্গে?’
সে দিন অবশ্য এই প্রতিবেদককে নওশাদের সাফ জবাব দেন, ‘কোনও সেটিংয়ের প্রশ্নই নেই। তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। বামেদের সাথে আসন সামঝোতা হয়ে গেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব।’ ওই দিন খানিকটা ‘অভিমান’ নিয়েই ভাঙড় থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদের একমাত্র সদস্য রাইনুর হক, ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য লড়াকু নেত্রী আসমা খাতুনও বিধায়কের সঙ্গে ‘সৌজন্য’ সাক্ষাৎটুকুও করেননি।
এ ব্যাপারে দু’জনেই কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আইএসএফের এক ব্লক স্তরের নেতা পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, ‘২০২১ সালে ভাঙড় বিধানসভায় (১৩টি অঞ্চল) আমরা মাত্র ২৬ হাজার ভোটে জিতেছিলাম। যার মধ্যে ভাঙড় ১ ব্লকের জাগুলগাছি, প্রাণগঞ্জ, নারায়নপুর এলাকায় দশ হাজার ভোটের লিড পেয়েছিলাম। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই তিনটি এলাকায় আমরা প্রার্থী দিতে পারেনি।
ভাঙড়-২ ব্লকের বেঁওতা ১ ও ২ এবং বামনঘাটা এলাকায় আমাদের কোনও ভোটব্যাঙ্ক নেই। তার মানে সম্মান বজায় রাখতে হলে সাতটা অঞ্চল থেকে ২৬ হাজারের বেশি মার্জিন বাড়াতে হবে। কিন্তু ভোটে আমরা লড়াই করব, নাকি হাত গুটিয়ে বসে থাকব সেটাই এখনও পরিষ্কার করেননি ভাইজান।’
এ দিন অবশ্য তা পরিষ্কার করেছেন ভাইজান। ফুরফুরা শরিফে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘দলীয় শৃঙ্খলা মেনেই আমি ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র শুধু নয় লোকসভা ভোটে লড়াই করব না।’ তবে নওশাদ যাই বলুন না কেন, দিন কয়েক আগে তাঁর দলেরই সতীর্থ, ভাঙড়-২ ব্লকের আইএসএফ সভাপতি রাইনুর হক বলেন, ‘লড়াই না করলে তৃণমূল আমাদের বাড়ি ছাড়া করবে।’
ভাঙড়ের নিজের দলের কর্মীদের অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দেওয়ার পর নওশাদ সম্পর্কে কী বলছেন তাঁর জোটসঙ্গী সিপিএমের লোকজন? শ্রীরামপুর কেন্দ্রে প্রচারের ফাঁকে প্রশ্নটা শুনে মুচকি হাসলেন সিপিএম প্রার্থী দীপ্সিতা ধর। তাঁর ছোট্ট জবাব, ‘সব সেটিং করে চলছে।’