• School Board Exam : গণধর্ষিতা, তাই বোর্ড পরীক্ষা দেবে না!
    এই সময় | ০৬ এপ্রিল ২০২৪
  • এই সময়: নিজের কাকা ও তার দুই পরিচিত মিলে ধর্ষণ করেছিল মেয়েটিকে। সে গণধর্ষণের সেই ট্রমা কাটিয়ে চেয়েছিল ক্লাস টুয়েলভের বোর্ড পরীক্ষা দিতে। প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু পরীক্ষাটা আর দেওয়া হলো না। সৌজন্যে, তার স্কুল। নির্যাতিতা আর পাঁচ জনের সঙ্গে বসলে ‘পরিবেশ নষ্ট’ হবে, তাই তাকে বসতে দেওয়া হলো না জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা!এই একই যুক্তিতে তাকে স্কুলে যেতেও না করা হয়েছিল! ‘নষ্ট মেয়ের’ উপস্থিতি ‘নষ্ট করবে স্কুলের সুস্থ পরিবেশ!’ এই ঘটনার অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে অজমেরের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লিউসি)। তবে এই কিশোরী একা নয়। এই একই উদাহরণ রয়েছে বাংলাতেও। সেটা বছর কয়েক আগের কথা।

    উত্তর ২৪ পরগনার এক কিশোরী পাচার হয়ে গিয়েছিল অন্য এক শহরের যৌনপল্লিতে। সেখান থেকে সে একদিন পুলিশ ও এনজিও-র সাহায্যে ফিরে আসে। আদরের মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করেননি মা-বাবা। তবে সে যখন স্কুলে গেল, সেখানে তাকে তার প্রধান শিক্ষিকা বললেন, ‘তুমি বাজে মেয়ে। তুমি স্কুলে এলে অন্যরা খারাপ হয়ে যাবে!’

    বছর ১৫-র কিশোরী আঁতকে উঠেছিল এই কথা শুনে। সে বোঝেনি তার কী দোষ ছিল এতে। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসেছিল সে। পরে এই সংবাদ প্রকাশ হলে নড়েচড়ে বসে জেলা প্রশাসন। সেই প্রধান-শিক্ষিকাকে শো কজ় করা হয়। মেয়েটি সেই স্কুল থেকেই পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দেয়।

    অন্য গল্প নয় আর এক নাবালিকারও। পাশের পাড়ার কয়েক জন তাকে গণধর্ষণ করেছিল। এফআইআর হতেই অভিযুক্ত পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ। দীর্ঘ কাউন্সেলিংয়ের পরে সে ফের নিজের স্কুলে ফিরতে চেয়েছিল। তাকে সরকারি মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি জানিয়ে দেয়, ‘এ সব নোংরা মেয়েরা এই স্কুলে পড়ে না। তোর জন্য বাকিরাও নষ্ট হয়ে যাবে!’ রাজ্য সরকার পড়ুয়াদের যে সাইকেল দেয়, তা-ও তাকে দেওয়া হয়নি মাদ্রাসা থেকে। সে পরে প্রাইভেটে ক্লাস টেনের পরীক্ষা দিয়েছিল।

    দেশের নানা প্রান্তে এমনও দেখা গেছে কোনও মেয়ের যদি স্কুলে থাকতে বিয়ে হয়ে যায় বা তারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে, তাদেরও অনেক সময়ে ‘অন্যদের ভালোর জন্য’ ক্লাসে আসতে না করে দেওয়া হয়। পরীক্ষার প্রস্তুতি বাড়িতেই নিতে বলা হয়। রাজস্থানের এই বেসরকারি স্কুলটিও তার বাইরে নয়। মেয়েটির কোনও অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও ‘স্কুলের পরিবেশ নষ্ট হবে’ এমন একটি অচল যুক্তিতে তাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ বাড়িতে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। ছাত্রীটি তাই-ই করেছিল।

    সে জানিয়েছে, পরীক্ষার আগে যখন স্কুল থেকে অ্যাডমিট কার্ড আনতে গিয়েছিল, তখন স্কুল তাকে বলে যে সে ওখানকার ছাত্রীই আর নয়! কারণ সে একটানা চার মাস স্কুলে আসেনি। তাই নাম কেটে দেওয়া হয়েছে। ফলে নেই কোনও অ্যাডমিট কার্ড। পরে ছাত্রীটি জানতে পারে, তার গণধর্ষণের ঘটনার পর পরই স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়েছে, কারণ অন্য পড়ুয়াদের অভিভাবকরা নাকি নির্যাতিতার সঙ্গে নিজের সন্তানদের পড়তে দিতে রাজি ছিলেন না!

    স্কুলের এমন আচরণে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে কিশোরী। সে অন্য স্কুলের এক শিক্ষিকাকে পুরো বিষয়টি জানালে ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে। ওই শিক্ষিকা ছাত্রীটিকে চাইল্ড হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করার পরামর্শ দেন। ফোন পেয়েই তৎপর হয় অজমেরের সিডব্লিউসি। বিষয়টিতে তৎপর হয়েছে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি(সিডব্লিউসি)। মামলা দায়ের করেছে তারা। তদন্তে স্কুল কর্তৃপক্ষের দোষ প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনেরও।

    সিডব্লিউসি-র চেয়ারপার্সন অঞ্জলি শর্মা জানান, তিনি নির্যাতিতার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। আইনগত ভাবে তদন্ত চলছে। তবে মার্চে বোর্ডের পরীক্ষা দিতে না-পারা এই কিশোরী যাতে অবিলম্বে বোর্ড-পরীক্ষায় বসতে পারে, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। সব কিছু বিস্তারিত ভাবে জানিয়ে, এ ব্যাপারে জেলার এডুকেশন অফিসারকে চিঠিও লিখেছেন তিনি, যাতে ওই ছাত্রীর কোনও শিক্ষাবর্ষ নষ্ট না হয়। তাঁর কথায়, ‘মেয়েটি যথেষ্ট মেধাবী। দশমের বোর্ড পরীক্ষায় ৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। দ্বাদশের পরীক্ষায় বসতে পারলে হয়তো আরও ভালো রেজাল্ট করত। স্কুলের জন্য তার এক বছর নষ্ট হতে চলেছে। আমরা সেটা আটকানোর চেষ্টা করছি।’

    সমাজকর্মীরা মনে করছেন, প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, নয় কোনও এনজিও না হলে প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে নির্যাতিতাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে। বহু ক্ষেত্রে মা-বাবা পাশে থাকেন না ‘নষ্ট মেয়েদের’ কিন্তু এখানে স্কুলই তাদের সঙ্গে অমানবিক ও অন্যায় আচরণ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বাঁচাও,বেটি পঢ়াও’, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের স্কুল স্তরে নানা সচেতনতামূলক প্রকল্প রয়েছে। লক্ষ্য একটাই, কোনও মেয়ে যদি কদর্য অপরাধের শিকার হয়, সে ধর্ষণ হোক বা যৌন নির্যাতন বা পাচারের পরে দেহব্যবসা বা অন্য কিছু — তাদের কোনও অপরাধ নেই। সেটা একটা দুর্ঘটনা।

    তাই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে অভিভাবকদের আর স্কুলকে। এক মেন্টাল হেল্থ এক্সপার্টের মতে, বাড়ি আর স্কুলকেই যে কোনও শিশুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তাই টিচারদের সেনসিটাইজ়েশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবেই। সমাজতত্ত্বের এক প্রফেসরের মতে, বর্তমান সমাজও যে কোনও যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে মহিলাদের দিকেই আঙুল তোলে।

    নির্যাতিতা মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র-পোশাক, সব ক্ষেত্রেই হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ। এই গোত্রের শিক্ষিকারাও ওই সমাজের সেই ‘পিতৃতান্ত্রিক সংখ্যাগুরু মতে’ বিশ্বাসী। সে জন্যই নিজেদের সঙ্গে লড়াই করে, ট্রমা-স্টিগমা পেরিয়ে মেয়েরা যখন লড়াই করতে চায়, তাদের আটকে দেয় এমন মানসিকতা। সেই অচলায়তন তো ভাঙতে পারে একমাত্র শিক্ষাই... সেখান থেকে চেতনা। চেতনা থেকে মুক্তি।
  • Link to this news (এই সময়)