মণিপুষ্পক সেনগুপ্ত : ভোটের হাওয়ায় সন্দেহের গন্ধ! এই গন্ধটাই এ বারের লোকসভা ভোটে ট্রেন্ডিং। শত্রু শিবিরের দুর্গে অবিশ্বাসের চোরাস্রোত বইয়ে দেওয়ার এমন কৌশল অতীতে বঙ্গ-ভোটে দেখা যায়নি।
লোকসভা ভোটের প্রচার জোরকদমে চলছে। তৈরি হচ্ছে শত্রু শিবিরকে হারানোর গোপন স্ট্র্যাটেজি। তবে সেই স্ট্র্যাটেজি কি গোপন থাকছে না? নাকি গোপনে তা চালান হয়ে যাচ্ছে প্রতিপক্ষের ডেরায়? চালান হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা তর্কের বিষয়। তবে শত্রুর ডেরায় ‘বিভীষণ’ আছেন, এই খবরটা কৌশলে বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছে শাসক-বিরোধী দু’পক্ষই।এমনকী, ক্ষেত্র বিশেষে তারা ফাঁস করে দিচ্ছেন ‘গুপ্তচর’-এর নামও! প্ল্যান অবশ্য একটাই, সন্দেহের তিরে প্রতিপক্ষকে বিদ্ধ করা। শনিবারই যেমন মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে বর্ধমান-দুর্গাপুরের বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তৃণমূলের টিকিটে লড়ছেন কীর্তি আজাদ। কিন্তু ওঁর পার্টিই তো ওঁকে সাহায্য করছে না।’
এরপরই মুচকি হেসে তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘আমি যদি বলি কীর্তি আজাদের পার্টি আমাকে সাহায্য করছে।’ অর্থাৎ, দিলীপ বার্তা দিতে চেয়েছেন, তৃণমূলের একাংশই আজাদকে হারাতে চাইছে। রাজনৈতিক মহলের মতে, যাঁদের ভরসায় ভিন্ রাজ্য থেকে কীর্তি আজাদ বাংলায় ভোট লড়তে এসেছেন, তাঁদের সম্পর্কে আজাদের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়াই দিলীপের লক্ষ্য। একবার লক্ষ্যভেদ হলে ভোট-যুদ্ধে তিনি যে অ্যাডভান্টেজ পাবেন, তা বিলক্ষণ জানেন দিলীপ।
শুধু দিলীপই নন, ভোটের মুখে ‘সন্দেহ-বান’ ছুড়তে দেখা গিয়েছে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষকেও। ক’দিন আগেই কুণাল দাবি করেন, উত্তর কলকাতার তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেতাতে ‘সাহায্য’ করছেন বিজেপির উত্তর কলকাতার সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ!
সাংবাদিকদের সামনেই কুণাল বলেছিলেন, ‘তমোঘ্ন যখন তৃণমূলকে এতই সাহায্য করছেন, তখন ভোটের পর তাঁকে তৃণমূলে ফেরানো যায় কি না, তা নিয়ে নেতৃত্ব নিশ্চয়ই ভাবনা-চিন্তা করবেন।’ তৃণমূল নেতার এই বিবৃতির পর উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী তাপস রায় সন্দেহের চোখে তমোঘ্নর দিকে তাকিয়েছিলেন কি না, বোঝা কঠিন। তবে ঝুঁকি নেননি তমোঘ্নও। তিনি কুণালের দিকে পাল্টা ‘সন্দেহ-বান’ দেগেছেন। তড়িঘড়ি তমোঘ্ন সাংবাদিক বৈঠক ডেকে দাবি করেন, সুদীপকে হারাতে কুণালই বিজেপিকে বিভিন্ন ‘ইনপুট’ দিচ্ছেন।
ভোটের মুখে এ সব ‘সন্দেহজনক’ কাণ্ডকারখানা দেখে এক বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতার সরস টিপ্পনি, ‘এই প্রথম দেখলাম, যুদ্ধ শুরুর আগে গুপ্তচরের কথা এ ভাবে খোলাখুলি বলে দেওয়া হচ্ছে। সবাই যদি তাঁকে চিনেই যান, তা হলে আর তিনি গুপ্তচরবৃত্তি করবেন কী ভাবে!’
এ বারের ভোট-যুদ্ধে সন্দেহের অস্ত্রে শান দিচ্ছে সিপিএমও। সম্প্রতি আইএসএফের সঙ্গে জোট ভেঙেছে তাদের। শুক্রবার থেকেই বাম নেতারা আইএসএফের রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে সন্দেহের আবহ তৈরি করছেন। সরাসরি আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির নাম না করে সিপিএম নেতারা তাঁর সঙ্গে বিজেপি-আরএসএসের গোপন আঁতাঁত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সংখ্যালঘু ভোটারদের মনে আইএসএফ সম্পর্কে সন্দেহের বীজ বপন করতেই এই কৌশল।সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের মতে, ‘এটা এক রকমের গেমপ্ল্যান। প্রতিপক্ষের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দাও। কুণাল ঘোষ অথবা দিলীপ ঘোষদের দাবি তাঁদের প্রতিপক্ষরা বিশ্বাস যদি না-ও করে, তবুও কিছু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করবেই। নিজের দলের লোকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে হয়তো মনে কোথাও একটা সংশয় কাজ করবে, খবরটা শত্রু শিবিরের কাছে চলে যাবে না তো!’
সন্দেহের তির ছুড়ে কার কতটা লাভ হলো সেটা ভোটের শেষেই বোঝা যাবে। কিন্তু একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই—গন্ধটা খুবই সন্দেহজনক!