‘দিন দুয়েক চোখে ঘুম নেই। দিনে ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ। দু’লিটার এনার্জি ড্রিঙ্ক খেয়ে চিল করেছি। মাথার উপর দিয়ে কামানের গোলা উড়ে যাচ্ছে। এর পরে রাশিয়ানরা ১২০ মিলিমিটার মর্টার সেল ছুড়তে লাগল। বাধ্য হয়ে ট্রেঞ্চে নেমে গেলাম। প্রায় ২০টা ছোড়ার পর, ১০-২০ মিটার দূরে পৌঁছে থেমে গেল ওরা। দিনটা ঠিক ভাবেই শেষ হল, শুধু দেহে অনেক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন (মর্টার সেলের জন্য)। আমাদের কাজ সফল। পজ়িশন ছেড়ে ফিরে বিশ্রাম পেলাম। এমআরআই হল পরের দিন।’উপরের বর্ণনা যে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন থেকে, বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু পাকা যোদ্ধার মতো নিজেদের পরিস্থিতির রিপোর্ট দিয়েছেন যিনি, আড়াই বছর আগেও জানতেন না, বন্দুক কী করে ফায়ার করে। মিসাইল ইকুইপড ড্রোন ওড়ানো তো দূরের কথা! কিন্তু রুশদের থেকে দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধে নেমেছেন আলেক্সান্ডার ডোলগোপোলভ।
এ বার কি চেনা লাগছে? অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, উইম্বলডন চলাকালীন নামটা কানে এসেছে? আলবাত এসেছে। এক সময়ে টেনিসে সিঙ্গলস এটিপি ব়্যাঙ্কিংয়ে ১৩ নম্বরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বিখ্যাত হয়েছিলেন কুইন্স ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে রাফায়েল নাদালকে হারিয়ে। কব্জির চোটের জন্য ২০১৮-এর পর থেকে কোর্টে নামতে পারছিলেন না। অবসর ঘোষণা করেন ২০২১ সালে।
এর বছর খানেকের মধ্যে ইউক্রেন আক্রমণ করল রাশিয়া। ডোলগোপোলভ যোগ দিলেন মিলিটারি ট্রেনিংয়ে। কব্জির ব্যথা বাধা হল না, অ্যাসল্ট রাইফেল চালানোর ক্ষেত্রে। পটু হয়ে উঠলেন মিসাইল ইকুইপড ড্রোন ওড়ানোয়। এখন তিনি ইউক্রেনের ডাইরেক্টরেট অফ ইন্টেলিজেন্সের সদস্য। তাদের ট্রেনিং নিয়েই নেমেছেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
টেনিস তারকা হিসেবে যত না টুইট করতেন, তার থেকে অনেক বেশি অ্যাক্টিভ হয়ে গেলেন এই সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডলে। রুশদের উপরে অ্যাটাকের সেই ভিডিয়ো ক্লিপই আসতে থাকল তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে। তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট হতে থাকল দীর্ঘস্থায়ী ‘ওয়ার’-এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট ‘ব্যাটল’-এর ভিডিয়ো ক্লিপ।
কোথাও রাশিয়ার সেবাস্তোপোল বা বেলগোরোদে মিসাইল আছড়ে পড়ার ভিডিয়ো। কখনও ফ্রন্ট লাইনের কিছু হাড় হিম করা ভিডিয়ো। কোনও রাশিয়ান ট্যাঙ্ক এগোচ্ছে। তার উপরে বসে তিন রাশিয়ান সেনা। ভিডিয়োটি যে ক্যামেরায় তোলা সেই ক্যামেরাটি ক্রমশ এগিয়ে চলেছে ট্যাঙ্কের দিকে। আরও কাছে যেতে রাশিয়ান সেনারা ক্যামেরার দিকে তাকাল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। স্ক্রিনের ছবি উধাও।
সিগন্যাল কেটে যাওয়ার পরে যে অজস্র দানায় স্কিন ভরে ওঠে, ঠিক সে রকম হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিয়োটা। ওখানেই শেষ। অনেক উঁচুতে থাকা অন্য আর একটি ড্রোন থেকে ওই ঘটনার ফুটেজ শেয়ার করা হয়। দেখা যায়, একটা কিছু এগিয়ে যাচ্ছে ট্যাঙ্কের দিকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে তিন সেনা যখন যখন সেই বস্তুটিকে দেখে ট্যাঙ্ক থেকে লাফিয়ে পড়তে গেল, তখনই বিস্ফোরণ। ছিটকে পড়ল তিনটে দেহ। ট্যাঙ্ক একদিকে কাত, আগুন জ্বলছে।
ডোলগোপোলভের টুইটার হ্যান্ডলের ডিসপ্লে-তে দেখা যায়, টেনিস কোর্টে র৵াকেট হাতে ফোরহ্যান্ড মারছেন। এখনও আছে সেই ছবি। কিন্তু মানুষটা বদলে গিয়েছেন। এ রকম বদল হয়েছে অনেকের। ইউক্রেনের আর এক টেনিস তারকা সের্জি স্তাকোভস্কিও যোগ দিয়েছেন সেনাবাহিনীতে। হেভিওয়েট বক্সার দুই ক্লিৎস্কো ভাইদের কথা অনেকের মনে থাকবে। ভিতালি ও ভ্লাদিমির। ভিতালি কিইভের মেয়র। ভ্লাদিমিরও যুদ্ধ শুরুর পর চলে গিয়েছিলেন ফ্রন্টলাইনে।
এই ফ্রন্টলাইনের অভিজ্ঞতা জানা যায় ডোলগোপোলভের থেকে। বলেছেন, ‘যখন ওরা গুলি চালাতে চালাতে খুব কাছে, তখন তুমি জানো যে ওরাও জানে তোমার অবস্থান।…একটা বাঁশির মতো শব্দ, তার পরেই গুলি আছড়ে পড়ার আওয়াজ। তখন শুধু আশা করতে হয়, ট্রেঞ্চের মধ্যে যেন না এসে পড়ে।’
ফ্রন্টলাইনে থাকাকালীন প্রতি মুহূর্তে এই ভয়ের কথা বলেছেন ডোলগোপোলভ। আবার ট্রেঞ্চ থেকে ফিরে ক’ দিনের বিশ্রাম। সেই সময়ে যুদ্ধের ভিডিয়ো পোস্টের সঙ্গে কিছু পলিটিক্যাল পোস্টও। বুঝিয়ে দেওয়া, ইউএসএ-র সব স্ট্র্যাটেজিই ঠিক নয়। বা, ফ্রান্স কখন সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সাম্প্রতিক পোস্টের অনেকগুলোই রাশিয়ান তৈলখনিতে মিসাইল অ্যাটাকের। প্রতি মুহূর্তে জানান দিয়ে যাচ্ছেন, শক্তিশালী রাশিয়ার বিরুদ্ধেও কী ভাবে লড়ে যাওয়া যায়।