Lok Sabha Election 2024 : জনমত সমীক্ষার নামে ভোটপ্রচার?
এই সময় | ০৭ এপ্রিল ২০২৪
সুমন সেনগুপ্ত : ২০২৪-এর নির্বাচনের প্রথম ভোট পড়তে আর বেশি দিন নেই। ২০২৯ সালে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর প্রস্তাবও পেশ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই রকম, শুধু লোকসভার নির্বাচন হয়তো শেষবার হতে চলেছে। আচরণবিধি মেনে প্রচার শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন সারা বছরই হয় নিজের, নয় তাঁদের দলের হয়ে প্রচারের কাজ করেন।সরকারি কোনও প্রকল্প উদ্বোধন থেকে শুরু করে, রেলের বাথরুম কিংবা কোনও সুলভ শৌচালয় উদ্বোধনের ক্ষেত্রেও গত দশ বছরে এই প্রচার নিত্যদিন আমরা দেখেছি, বিভিন্ন চ্যানেলে, বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। বিদেশ গেলেও, তাঁর ভাবমূর্তির প্রচার ছাড়া কিছু দেখা যায় না।
পাশাপাশি, অন্য আর এক ধরনের প্রচার চালানো হয়, যাকে সরাসরি প্রচার না বলেও আরও বড় প্রচার বলা যায়। সামাজিক মাধ্যমের যুগে তো এটা বলাই যায়, কারণ আজকের সময়ে কোনও প্রচারই একদিনে শেষ হয় না। সমস্ত প্রচার, সমস্ত ছবি, সমস্ত কথাই থেকে যায় এবং ফিরে আসে। মানুষের স্মার্ট ফোনে ঘুরতে ঘুরতে মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ ঢুকে যায়, সেই প্রচার। ওই প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার আজকের ‘জনমত সমীক্ষা’।
যে সমীক্ষা দেখে সাধারণ নির্বাচকদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই, বিভিন্ন সংস্থা ‘জনমত সমীক্ষা’ করে, কিন্তু সেটাও বকলমে নরেন্দ্র মোদীর দলের সাফল্য নিয়েই প্রচার করে থাকে। অথচ যে দিন এই ধরনের সমীক্ষা শুরু হয়েছিল, সেদিন কি একটি দল বা ব্যক্তির সাফল্য প্রচার করাই এই সমীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল?
১৯৬০ থেকে সেন্টার ফর স্টাডিজ় অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস বা CSDS এই কাজটা করার চেষ্টা করছে, নির্বাচকদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে। যদিও আজকের সময়ে, যেভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়, তাতে এক একজনকে জ্যোতিষী ছাড়া কিছু মনে হয় না। আজকের সময়ের সমীক্ষা, যত না মাটিতে নেমে সমীক্ষা, তার থেকে অনেক বেশি প্রচার, তার মধ্যে নির্বাচকদের ভাবনাচিন্তার কতটা প্রতিফলন হয়, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়।
আজকে যে কোনও নির্বাচক যদি, যে কোনও প্রচলিত গণমাধ্যমের এই ধরনের জনমত সমীক্ষা দেখেন, তা হলে তাঁর মনে হতে বাধ্য, এর মধ্যে কিছু একটা সন্দেহজনক আছে, তাঁর মনে হতে বাধ্য, এই বিষয়টাই একটি রাজনৈতিক দলের তৈরি করা চমক ছাড়া কিছু নয়। এই জনমত সমীক্ষা দেখে আসল নির্বাচনে কী ফল হতে চলেছে, তা নির্ভুল ভাবে বলা কঠিন, কারণ অতীতে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সমীক্ষায় দেখানো আর নির্বাচনের ফল সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছে।
এই ধরনের সমীক্ষা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। প্রথমত প্রচুর সংখ্যক নির্বাচকের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো জরুরি, যাতে সঠিক ফলাফলের খুব কাছাকাছি পৌঁছোনো যায়। যত বেশি মানুষের কাছে যাওয়া হবে, তত গাণিতিক ভাবে এই ফলাফল সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দ্বিতীয়ত, সমাজের প্রায় প্রত্যেকটি স্তরের মানুষের, নারী পুরুষ, নির্বিশেষে যদি অংশগ্রহণ না থাকে, এই সমীক্ষাগুলোতে, তা হলে সেই সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
তৃতীয়ত যে প্রশ্নগুলো করা হবে, কিংবা যিনি প্রশ্নকর্তা, তাঁর প্রশ্ন করার ধরনের মধ্যে যেন উত্তরের আভাস না থাকে। অর্থাৎ এমন যেন কখনওই মনে না হয়, প্রশ্নকর্তা একটা নির্দিষ্ট উত্তর পেতে চাইছেন বলে প্রশ্ন করছেন। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু দিকে নজর রাখা প্রয়োজন, কোনও একটি জনগোষ্ঠীকে যদি প্রশ্ন করা হয়, সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাঁদের প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাঁদের সবাইকে যেন সমান সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রথম থেকেই যেন মাথায় রাখা হয়, সমীক্ষার জন্য যেন সঠিক মানুষ বেছে নেওয়া হয়। এমন প্রশ্ন করা উচিত, যা সবাই সহজে বুঝতে পারেন, প্রশ্ন করতে হবে, যাতে মানুষ উৎসাহিত হয়ে উত্তর দেবে। ‘জনমত সমীক্ষা’ শব্দবন্ধটি শুনলে বা ভোট পরবর্তী সমীক্ষায় এই শব্দগুলো শুনলেই প্রথমে যে নামটা মনে আসে, তিনি প্রণয় রায়। ১৯৭৯-৮০ সালে যখন থেকে সাধারণ মানুষের ঘরে টেলিভিশন ঢুকেছে, তখন থেকেই আমরা নির্বাচনের আগে এবং শেষে এই ধরনের সমীক্ষা দেখতে শুরু করি।
১৯৯০-এর পরে যখন প্রায় প্রতিটি ঘরে টেলিভিশন পৌঁছে গেছে, তখন এই সমীক্ষা আরও জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম দিকে এই ধরনের সমীক্ষা জাতীয় স্তরের কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তার পরে চাহিদা বাড়ায়, তা দৈনিক পত্রপত্রিকাতেও প্রকাশিত হতে থাকে। তার পরে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল বাড়তে থাকে এবং সেগুলোতে দেখানো শুরু হয়। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, কে বা কারা কতটা সঠিক অনুমান করতে পারে, ভোটের ফল।
প্রাথমিকভাবে নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলেও ওই সমীক্ষা চালানো হত, কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। নির্বাচন কমিশনের মনে হয়েছিল, এতে নির্বাচকেরা প্রভাবিত হতে পারেন। একে তো বেশিরভাগ গণমাধ্যমেরই মালিকানায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে আজকের কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সাম্প্রতিক নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হওয়ার পরে প্রমাণিত, দ্বিতীয়ত সমীক্ষাগুলো টেলিভিশনে দেখানো বন্ধ হলেও, স্মার্ট ফোনের দৌলতে এই সমীক্ষাগুলোকেই প্রচারের হাতিয়ার করা হয়েছে।
যদি বারংবার একই কথা, গোয়েবেলসীয় ধাঁচায় পৌঁছে দেওয়া যায়, যে ‘আব কি বার চারশো পার’, যে কারওর পক্ষে তা অস্বীকার করা কঠিন। নির্বাচন কমিশনও এই বিষয়ে কতটা সচেতন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এই প্রচারে তাঁদেরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে।