• একের বদলে চার কন্যার খোঁজ! ধৃত ২ পাচারকারী
    এই সময় | ০৮ এপ্রিল ২০২৪
  • অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়

    দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর থানা থেকে দিল্লির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘মিশন মুক্তি ফাউন্ডেশন’-এর কাছে একটি চিঠি এসেছিল বছর ১৪-র এক কিশোরীকে উদ্ধার করায় সাহায্য করার অনুরোধ নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘ওই মেয়েটিকে তার এক পরিচিত দেখেছে জিবি রোডের কোঠা নম্বর ৫৬-এ।’ এই অঞ্চল রাজধানীর যৌনপল্লি, যাকে অনেকেই এশিয়ার অন্যতম বড় ব্রথেল বলে মনে করেন। কাজেই বিষয়টা খড়ের গাদায় অনেকটা ছুঁচ খোঁজার মতোই ছিল।তবে ওই সংস্থার ডিরেক্টর বীরেন্দর কুমার সিং ও আরও কিছু লোক যখন জিবি রোডে রেকি করতে যান, তখন জানতে পারেন ‘সুস্মিতা’ ওরফে মঞ্জিলা বিবি লস্কর নামে এক মহিলা কোঠা নম্বর ৭০-এর মালকিন। কিন্তু সে এখন আর সেখানে থাকে না, কোঠা নম্বর ৫৬ এখন তার ঠিকানা। মঞ্জিলার স্বামী মহম্মদ হাসেন আলি মোল্লা নিয়মিত মেয়ে নিয়ে আসত বাংলা ও অসম থেকে। তার পরে সে তাদের মঞ্জিলার হাতে তুলে দিত দেহব্যবসায় নামানোর জন্য।

    এই সব খোঁজখবর নিয়ে মিশন মুক্তি, রেসকিউ অ্যান্ড রিলিফ ফাউন্ডেশন, দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের টিম সেখানে অভিযান চালায় দিন কয়েক আগে। কিন্তু ৫৬ নম্বর কোঠায় মঞ্জিলা বা ওই কিশোরী কাউকেই পাওয়া যায়নি। সেদিন সকলে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এই মঞ্জিলা ও হাসান অন্য একটি নাবালিকা পাচার মামলায় অভিযুক্ত, যেটি এখন দিল্লির সিডব্লিউসি-৫ খতিয়ে দেখছে।

    ওই কমিটির সদস্য রূপ সুদেশ বিমলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন উদ্ধারকারীরা। তাঁকে পুরোটা জানানো হলে সিডব্লিউসি-৫ এর তরফে তিনি মঞ্জিলাকে ডেকে পাঠান আগের মামলাটির পরিপ্রক্ষিতে। সে হাসেনকে নিয়েই সেখানে আসে। রেডিই ছিল পুলিশ। তাঁরা সাধারণ পোশাকে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই ওই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিশ। আপাতত তাদের দু’দিনের জেল হেফাজত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ খুব তাড়াতাড়ি তাদের রিম্যান্ডে নেবে। বিমলের কথায়, ‘হাসেন নিয়মিত বাংলা ও অসম থেকে মাইনর মেয়েদের নিয়ে আসত প্রস্টিটিউশন করানোর উদ্দেশ্যে।’

    দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর, মঞ্জিলাকে জেরা করে জানা যায় জয়নগরের ওই কিশোরী দিল্লির সিলামপুরে তাদের বাড়িতে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। বীরেন্দরের কথায়, ‘যাকে আমরা খুঁজতে গেছিলাম, সে তো ছিলই। ছিল আরও দু’জনও — একজন মালদার, অন্যজন বনগাঁর! সকলকেই সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়।’ যদিও বনগাঁর মেয়েটির দাবি সে ‘স্বেচ্ছায় প্রস্টিটিউশনে এসেছে।’

    তবে চমকের তখনও বাকি ছিল। মালদহের মেয়েটিকে দেখে সন্দেহ হয় সকলেরই। সে আধার কার্ড দেখিয়ে দাবি করে তার বয়স ২০ বছর, অথচ দেখে তা মোটেই কারও মনে হয়নি। সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লি পুলিশের তরফে যোগাযোগ করা হয় মালদা জেলা পুলিশের সঙ্গে। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাঠায়, মেয়েটি যে স্কুলে পড়ত সেখানকার রেকর্ড বলছে যে তার বয়স ১৫ বছর মতো, ২০০৯ সালে তার জন্ম! তখন সে ধাতস্থ হয়ে পুলিশকে বলে, তাকে মঞ্জিলা শিখিয়ে দিয়েছিল ২০ বছর বয়স বলার জন্য। আধার কার্ডটিও ভুয়ো বলে জানায় সে, যেটা হাসেনরা তার নামে বানিয়েছিল।

    মালদা পুলিশ এ-ও জানায়, ২০২১ সালে মা ও মেয়েকে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল দিল্লিতে। এনেছিল এই হাসেনই। তুলে দিয়েছিল মঞ্জিলার হাতে। দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর, মেয়েটির মা-কে অভিযুক্তরা দেহব্যবসায় নামতে বলে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। ফলে তার মেয়েকে নিজেদের কাছে রেখে দেয় হাসেন-মঞ্জিলা। তাঁকে ভয় দেখানো হতো যে তিনি যদি এই কাজ না করেন, তা হলে মেয়েকে তারা এই পেশায় নামিয়ে দেবে। দেখাও করতে দেবে না তার সঙ্গে। অবশেষে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা এই কাজে রাজি হন!

    তাই শনিবার রাতে সিলামপুর থেকে যখন তাঁর ১৪ বছরের মেয়ে মুক্ত হয়েছে খবর পেয়ে পুরো ঘটনা পুলিশকে বলেন। এ-ও জানান, তিনি এখনও কোঠা নম্বর ৭০-এ আছেন! তাঁর ফেরার কোনও পথ নেই। পাশপাশি তাঁর অভিযোগ, মেয়েকে মঞ্জিলারা জিবি রোডে নেয়নি ঠিকই কিন্তু তাকে দেহব্যবসায় নামিয়েছে ওরা। তাঁর মেয়েকে অনেক বিকৃতকামেরই জঘন্য যৌন অত্যাচারের শিকার হতে হয়। টাকা নেয় হাসেনরা।

    তিন কন্যারই ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে। দুই নাবালিকাকে আপাতত রাখা হয়েছে শেল্টার হোমে। বনগাঁর মেয়েটি এখনও কোনও ডিটেল জানায়নি। তবে দিল্লি পুলিশের এক কর্তা বলেই ফেললেন, ‘মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে মা এই পেশাকেই মেনে নিলেন, অথচ মেয়েটির কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। তিনি বলছেন, ফেরার পথ নেই... এই সমাজ বদলাবে কবে?’
  • Link to this news (এই সময়)