এই সময়: ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফের সমাজের মুক্ত মঞ্চে! ১১ বছর বাদে উলটপুরাণ! বছর নয়েকের এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের মামলায় যে আদালত দু’বারের ট্রায়াল শেষে দু’বারই অভিযুক্তকে প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল, সেই আদালতই তৃতীয়বার ট্রায়ালের পরে অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিল। ‘আনোখা’ এই ঘটনা মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডওয়ার।ঘটনার সূত্রপাত ২০১৩-র ২৯ জানুয়ারি। বছর নয়েকের ওই নাবালিকা বাড়ি থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। পর দিন তার দেহ উদ্ধার হয়। তদন্তে জানা যায়, ধর্ষণের পরে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে তাকে। ঘটনায় আনোখিলাল নামে এক অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অপহরণ, জোর করে বিয়ের উদ্দেশ্যে তুলে নিয়ে যাওয়া, ধর্ষণ, প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার এবং খুনের মতো ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারার পাশাপাশি পকসো আইনেও মামলা রুজু হয়।
খাণ্ডওয়ার বিশেষ আদালত দু’সপ্তাহের মধ্যে ট্রায়াল শেষ করে আনোখিলালকে ফাঁসির সাজা শোনায়। সাজা বহাল রাখে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টও। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয় আনোখিলালের তরফে। ২০১৯-এ শীর্ষ আদালত রায় খারিজ করে ফের শুনানির জন্য ফিরিয়ে দেয় নিম্ন আদালতেই। নতুন করে শুনানি শুরু হয় খাণ্ডওয়ার বিশেষ আদালতে।
২০২৩-এ আবারও বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ফাঁসির সাজা শোনায় আদালত। এরপরে রায় চ্যালেঞ্জ করে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টে যান আনোখিলাল। হাইকোর্ট ফের নতুন করে ট্রায়ালের নির্দেশ দেয়। সম্প্রতি সেই মামলার ট্রায়াল শেষ করে অভিযুক্তকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিয়েছে বিশেষ কোর্ট।
বিচারক প্রাচী প্যাটেল অভিযুক্তকে খালাসের নির্দেশ দিতে গিয়ে জানান, পুলিশ ‘লাস্ট সিন উইথ’ অর্থাৎ নিহত নাবালিকার সঙ্গে অভিযুক্তকে শেষবার দেখার যে তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পেশ করেছে, তা পর্যাপ্ত নয়। কারণ, ওই নাবালিকার সঙ্গে আনোখিলালকে শেষবার দেখার মতো প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজ মিললেও নাবালিকার দেহ উদ্ধার হয় তার ৩৬ ঘণ্টা পরে।
ওই সময়ে ঠিক কী ঘটেছিল, অন্য কোনও ব্যক্তি ঘটনাস্থলে থাকতে পারে — এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অভিজ্ঞ আইনজ্ঞরা মনে করছেন, নিম্ন আদালতের সাজা পরে উচ্চ আদালতে সম্পূর্ণ বা আংশিক খারিজ করেছে, এমন নজির বহু আছে। কিন্তু হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ট্রায়াল কোর্টেই একাধিক বার বিচারপ্রক্রিয়া শেষের পরে এ ভাবে প্রাণদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত কেউ বেকসুর খালাস হয়েছেন, এমন ঘটনার নজির বড় একটা নেই।
আইনজীবী অনির্বাণ গুহ ঠাকুরতার বক্তব্য, ‘উচ্চ আদালত দু’বার ট্রায়াল কোর্টের রায় খারিজ করে নতুন করে বিচারের নির্দেশ দিয়েছে এবং তারপরে অভিযুক্ত বেকসুর হচ্ছেন — এই ঘটনা অন্তত স্মরণাতীত কালে নেই। তবে এ ক্ষেত্রে যে অভিযুক্ত ১১ বছর ধরে জেল খাটলেন, তাঁর এতদিনের সামাজিক মান-মর্যাদার যে ক্ষতি হলো, তা কে পূরণ করবে?’
কোথা থেকে ঘুরে গেল মামলার গতিপ্রকৃতি? আদালত সূত্রে খবর, নাবালিকার দেহ উদ্ধারের সময়ে ঘটনাস্থল থেকে একটি দেশলাই বাক্স, বিস্কুটের প্যাকেট, পাঁচ টাকার একটি কয়েন এবং মৃতার হাতের মুঠো থেকে আটটি চুল পাওয়া যায়। এরপরে প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে যাঁরা আনোখিলালকে ওই নাবালিকার সঙ্গে শেষবার দেখেছিলেন, তাঁদের বয়ানের ভিত্তিতে অভিযুক্তের খোঁজ শুরু হয়।
কেউ খবর দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। ২০১৩-র ৪ ফেব্রুয়ারি আনোখিলালকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। প্রথমবার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও বিভিন্ন নথি দেখে আদালত তাঁকে প্রাণদণ্ডের সাজা দিলেও সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে। শীর্ষ আদালতের যুক্তি ছিল — আনোখিলাল উপযুক্ত আইনি পরিষেবা পাননি।
দ্বিতীয়বার শুনানিতেও ট্রায়াল কোর্ট মৃত্যদণ্ড বহাল রাখে। কিন্তু এরপরে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টে আবেদন করা হলে সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। হাইকোর্ট জানায়, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট যিনি তৈরি করেছিলেন, সেই বিশেষজ্ঞের বক্তব্যে তদন্তকারীরা বেশি রকম ভরসা করছিলেন। অথচ তা ঠিকমতো পরীক্ষাই করা হয়নি। এরপরে ফের ট্রায়াল কোর্টে মামলা ফেরত পাঠানো হয়।
তৃতীয়বারের ট্রায়ালে দিল্লির ন্যাশনাল ল’ইউনিভার্সিটি আনোখিলালকে আইনি সহায়তা দেয়। শুনানি চলাকালীন আদালত জানায়, নাবালিকার দেহ থেকে উদ্ধার করা সোয়াবের নমুনায় একজন পুরুষের ডিএনএ মিলেছিল। তবে সোয়াবে আনোখিলালের ডিএনএ-র অস্তিত্ব মেলেনি। তা হলে আনোখিলালই যে ধর্ষণ ও খুন করেছেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
বিচারক বলেছেন, ‘এই সায়েন্টিফিক এভিডেন্সই অভিযুক্তকে বেকসুর খালাসের পক্ষে যথেষ্ট।’ আদালতে এটাও উঠে আসে যে, অকুস্থলে পাওয়া সিমেনের নমুনা অন্য কোনও ব্যক্তির। ফলে আনোখিলাল বাদে অন্য কারও অপরাধে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা জোরালো হয়।
পুলিশের যুক্তি ছিল — ঘটনার পরে আনোখিলাল পালিয়ে যান, তাই তাঁকে অন্যতম সন্দেহভাজন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এই যুক্তিও খারিজ করে দিয়েছে আদালত। কোর্ট বলেছে, হতেই পারে যে তিনি কর্মস্থল থেকে বেতন আনতে গিয়েছিলেন। পুলিশের তরফে এমনও যুক্তি দেওয়া হয় যে, মৃতার হাতের মুঠো থেকে মেলা আটটি চুলের ডিএনএ-র সঙ্গে আনোখিলালের ডিএনএ ম্যাচ করে যায়।
কিন্তু আদালত বলেছে, যে ভাবে ওই নমুনা সংগ্রহ ও সিল করার পরে পরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে অনেক ত্রুটি ছিল। তৃতীয়বারের শুনানিতে এত ত্রুটি সামনে এলেও কী ভাবে একই তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত দু’বার আনোখিলালকে সাজা দিল, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।যদিও শেষ পর্যন্ত ১১ বছর বাদে বেকসুর খালাস হয়ে জেলমুক্ত হয়েছেন আনোখিলাল। কিন্তু এই ১১টা বছর তাঁকে ফিরিয়ে দেবে কে?