ঠাকুরবাড়ির প্রণামী বাক্সই কি হামলার নেপথ্যে! অস্বস্তিতে পদ্ম
এই সময় | ০৯ এপ্রিল ২০২৪
আশিস নন্দী, ঠাকুরনগর : শনিবার থেকে শুরু হয়েছে বারুনির মেলা। শুধু বিভিন্ন জেলা নয়, ভিন রাজ্য এমনকী বাংলাদেশ থেকেও লাখ লাখ ভক্তের ভিড়ে সরগরম ঠাকুরনগর। কামনা সাগরে ডুব দিয়ে ভক্তরা ভিড় জমিয়েছেন ঠাকুরবাড়িতে। বড়মা-র মন্দিরের প্রণামী বাক্স উপচে পড়েছে টাকায়। ভক্তের ভিড় ছিল ঠাকুরবাড়ির পাশে শান্তনু ঠাকুরের বাড়িতেও।কিন্তু এ বছর সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। ফলে প্রণামীর বাক্সও তেমন ভরে ওঠেনি। প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের অভিযোগ, সেই ক্ষোভেই গায়ের জোরে ঠাকুরবাড়ির দখল নিয়েছেন কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। যদিও শান্তনুর দাবি, বড়মা-র মন্দিরকে হেরিটেজ ঘোষণা করতে হবে। সেটাই চান মতুয়ারা। ভোটের মুখে গোটা ঘটনায় অস্বস্তিতে বিজেপি।
এ সবের মধ্যেই সোমবার দুপুরে শান্তনুর বাড়িতে জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার নাম করে বাংলায় লেখা একটি হুমকি চিঠি এসেছে। যা নিয়ে রহস্য দানা বেধেছে। রবিবার বনগাঁ কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর দলবল নিয়ে ঠাকুরবাড়ির তালা ভেঙে ঢুকে পড়েন। মেয়েকে নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসতে হয় তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ মমতাবালাকে।
সূত্রের খবর, বনগাঁ বিজেপির অন্দরেই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গেরুয়া শিবিরের অনেকেই মানছেন, ভোটের মুখে এমন ঘটনা ব্যুমেরাং হয়ে যেতে পারে। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঘটনা অনভিপ্রেত। এটা ঠাকুরবাড়ির পরিবারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এর সঙ্গে আমাদের দলের কোনও যোগসূত্র নেই। তবে ঠাকুরবাড়ির অন্দরে রাজনীতি ঢোকানোর কাজটা তৃণমূলই করেছে।’
তাঁর সংযোজন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ কার্যকর করেছে। তার বিরোধিতা করে মমতাবালাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে এরমধ্যে তৃণমূলই রাজনীতি ঢুকিয়েছে। ঠাকুরবাড়ির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা যেন বজায় থাকে, সেটাই আমরা চাই।’ এ বার বারাসত কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদার বনগাঁ দক্ষিণের বিধায়ক।
সেই স্বপন এ দিন বলেন, ‘মতুয়াদের ভাবাবেগে আঘাত করা কোনও ভাবেই উচিত নয়। আমার মনে হয়, পারিবারিক বিষয় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মিটিয়ে নেওয়া যেত। মনে রাখতে হবে বড়মা সকলের।’ বিষয়টি মতুয়ারাও অনেকে ভালো ভাবে নেননি। যেমন সুজয় বিশ্বাস নামে এক মতুয়া ভক্ত বলেন, ‘শান্তনু ঠাকুর যে কাজটা করেছেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। ভোটে এর জবাব আমরা দেব।’
মহারাষ্ট্র থেকে এসেছেন তপন মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘এ ভাবে আমাদের পবিত্র ঠাকুরবাড়ি দখল নেওয়া যায়? অতদূর থেকে এসে এ জিনিসও দেখতে হলো।’ অলোক বাচার নামে আর এক মতুয়া ভক্তের কথায়, ‘ঠাকুরবাড়ির কোন্দল বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছে। তা বলে এ ভাবে হামলা চালানো ঠিক হয়নি।’
রাজনৈতিক মহলের মতে বিষয়টি যে বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে, তা আঁচ করেছেন শান্তনুও। তাই মুখে কিছু না বললেও এ দিন মমতাবালাকে ঠাকুরবাড়িতে ঢুকতে তিনি বাধা দেননি। রবিবার রাতে বেরিয়ে যাওয়ার পর সোমবার দুপুরে গাইঘাটা থানার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে ঢোকেন মমতাবালা।
বুধবার রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে তাঁর শপথগ্রহণ। মঙ্গলবারই দিল্লির ফ্লাইট। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব ঘরে। শেষে শান্তনুর স্ত্রী সোমাই তালা খুলে দেন। শপথ নেওয়ার আগে সংসদে জমা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব নথি ব্যাগে ভরে নেন মমতাবালা। তিনি বেরোতেই ফের ঠাকুরবাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দেন শান্তনুর স্ত্রী।
মমতাবালার অভিযোগ, ‘প্রণামীর বাক্স ভরেনি। তাই টাকার লোভে শান্তনুরা এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন।’ যদিও শান্তনু বলেন, ‘সমগ্র মতুয়া সমাজ প্রয়াত বড়মা-র মন্দির হেরিটেজ করার পক্ষে। ভক্তরাই প্রথমে চাবি চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু না দেওয়ায় ভক্তরা গেটের তালা ভেঙে দখল নিয়েছেন। আমি ভক্তদের সহযোগিতায় ছিলাম।’
রবিবার রাতে গোলমালের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন শান্তনুর বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরও। শান্তনুর দাদা, গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর বলেন, ‘আমাদের ঠাকুরদা-ঠাকুমার ঘরটা দখল করে নিয়েছিলেন মমতাবালা ঠাকুর। আমরা চাই ওই ঘরটা ভক্তদের জন্য থাকবে। মমতাবালা থাকলে, ওই ঘরে আমরাও থাকব।’
১৯৮৫ সালে বড়মা বীণাপাণি দেবীর বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে এই ঠাকুরবাড়িতেই থাকেন মমতাবালা। শান্তনুরা থাকেন পাশের বাড়িতে। ঠাকুরবাড়িতে থাকার দৌলতে বড়মা-র মন্দিরের দেখভাল করেন মমতাবালা। মন্দিরের প্রণামীর বাক্সও থাকত তাঁর জিম্মায়। রবিবার থেকে সেই ঠাকুরবাড়ির দখল গেল শান্তনুদের হাতে।
মমতাবালা বলেন, ‘রবিবার রাত থেকে নিজের ঘরে ঢুকতে পারছি না। এক কাপড়ে রয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নারীসুরক্ষা নিয়ে অনেক কথা বলে গিয়েছেন বারাসতে। অথচ তাঁর মন্ত্রিসভার এক মন্ত্রী একজন বিধবাকে ঘর থেকে বের করে দিল। এর বিচার মতুয়ারাই করবেন।’