Election Ink: ৩ বার রং বদল! কেন সহজে মোছে না ভোটের কালি? জানুন 'ফর্মুলা'
এই সময় | ০৯ এপ্রিল ২০২৪
এগিয়ে আসছে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ট উৎসব। ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু দেশের ১৮ তম লোকসভা নির্বাচন। ভোট, অশান্তি, রাজনৈতিক তরজা, জয়ী দল, পরাজিত দল, এই সব কিছু নিয়ে নয়, এই প্রতিবেদন ভোটের কালি নিয়ে। বোটের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে তর্জনীতে কালির দায়। আঙুলে কালি দেওয়ার অর্থ ভোট দেওয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। সেই কালি কোথায় তৈরি হয়? কত দাম এই কালির? কী কী বিশেষত্ব রয়েছে? কেন এই কালি সহজে ওঠে না? আলোচনা সেসব নিয়েই।মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড বার্নিস লিমিটেড( MPVL) এই ধরনের কালি সরবরাহ করে। চলতি লোকসভা নির্বাচনে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোটের জন্য সর্বোমোট ২৬.৫৫ লাখ শিশি কালি সরবরাহ করবে। খরচ ৫৫ কোটি টাকা। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, ২০১৯ সালে নির্বাচনে লেগেছিল প্রায় ২৬ লাখ শিশি, খরচ হয়েছিল ৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এবার ২.২ শিশি বেশি সরবরাহ করা হচ্ছে। কোম্পানির ম্য়ানেজিং ডিরেক্টর মহম্মদ ইরফান এক সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ৩.৫৮ লাখ কালি শিশি উত্তরপ্রদেশে পাঠানো হয়েছে। লাক্ষাদ্বীপে পৌঁছেছে ১১০টি কালির শিশি।
কোন রাজ্যে কত লাখ কালির শিশি পাঠানো হয়েছে?
নির্বাচন কমিশনের মতে, এবার ভোটার সংখ্যা প্রায় ৯৭ কোটি। উত্তরপ্রদেশে রয়েছেন সর্বাধিক ভোটার, ভোটার সংখ্য়া ১৫.৩০ কোটি। অন্যদিকে লাক্ষাদ্বীপে সবচেয়ে কম ৫৭,৫০০ ভোটার রয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের পর মহারাষ্ট্রে সর্বাধিক ২.৬৮ লাখ কালির শিশি পাঠানো হয়েছে। এরপর পশ্চিমবঙ্গে ২ লাখ কালির শিশি, বিহারে ১.৯৩ লাখ, তামিলনাড়ুতে ১.৭৫ লাখ, মধ্যপ্রদেশে ১.৫২ লাখ, তেলেঙ্গানায় ১.৫০ লাখ, কর্নাটকে ১.৩২ লাখ, রাজস্থানে ১.৩০ লাখ, অন্ধ্র প্রদেশে ১.১৬ লাখ এবং এবং গুজরাট থেকে ১.১৩ লাখ কালির শিশি পাঠানো হয়েছে।
একটি শিশিতে কতটা কালি ধরে?
এক একটি বোতলে ১০ মিলি কালি ধরে। একটি বোতলের কালি ব্যবহার করে প্রায় ৭০০ জনের আঙুলের চিহ্ন দেওয়া হয়। একটি ভোটকেন্দ্রে প্রায় ১৫ শতাধিক ভোটার রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, এবার সারাদেশে ১২ লাখের বেশি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
এই কালির দাম কত? এই কালির এক লিটারের দাম প্রায় ১২,৭০০ টাকা। এক ড্রপের দাম হবে প্রায় ১২.৭ টাকা। এবার একটি ভায়াল কালির দাম করা হয়েছে ১৭৪ টাকা করে। গতবার সেই দাম ছিল ১৬০ টাকা করে।
২৫টি দেশে রপ্তানি করা হয় এই ভোটের কালি
নির্বাচনে ব্যবহৃত এই অমোচনীয় কালি শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যবহৃত হয়। কোম্পানির এমডি ইরফান জানান, কানাডা, ঘানা, নাইজেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মালদ্বীপসহ ২৫টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয় এই অমোচনীয় কালি। তবে এসব দেশে কালি লাগানোর পদ্ধতি ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, কম্বোডিয়া এবং মালদ্বীপে ভোটারকে তাঁর আঙুল কালিতে ডুবোতে হয়। বুরকিনা ফাসোতে এই কালি ব্রাশ দিয়ে প্রয়োগ করা হয়।
কতদিন ব্যবহার করা হচ্ছে এই কালি ?
১৯৫২ সালে ভারতে প্রথমবার যখন লোকসভা নির্বাচন হয়, তখন এই কালি ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি ১৯৫৭ সালের নির্বাচনেও ব্যবহার করা হয়নি এই কালি। এরপর নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোট সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। অন্যের হয়ে ভোট সহ একই ব্যক্তির দুই ভোট দেওয়ার অভিযোগ পায় নির্বাচন কমিশন। তখনই সমাধানের রাস্তা খোঁজা শুরু করে কমিশন। এর পরে নির্বাচন কমিশন ভারতের ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরিকে (এনপিএল) এমন এক কালি তৈরি করতে বলে যা জল বা কোনও রাসায়নিকের সাহায্যেও মুছে যাবে না।
এর পরে এনপিএল এই কালি তৈরির জন্য কর্নাটকের মাইসোর পেইন্টস এবং বার্নিশ লিমিটেড কোম্পানিকে অর্ডার দেয়। এই সংস্থাটি ১৯৩৭ সালে মহীশূরের মহারাজা কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে, এই সংস্থাটি কর্নাটক সরকারের হাতে চলে যায়।১৯৬২ সালের নির্বাচনে প্রথমবার মুছে যাবে না এমন কালি ব্যবহার করা হয়েছিল। ভারতীয় নির্বাচনে এই কালি ব্যবহারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনকে। ১৯৬২ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে এই কালি ব্যবহার করা হচ্ছে।
কেন এই কালি মুছে যায় না?
কোম্পানি কখনও এই কালি তৈরির ফর্মুলা শেয়ার করেনি। এই কালি তৈরিতে সিলভার নাইট্রেট রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। সিলভার নাইট্রেট এই কালিকে আলোক সংবেদনশীল করে তোলে, যার কারণে সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এলে এটি গাঢ় হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, জলের সংস্পর্শে আসার পর তা আরও গাঢ় রঙের হয়। এই কালি আঙুলে লাগালে তা বাদামি রঙের হয়ে যায়। তারপর কিছু সময়ের মধ্যে তা গাঢ় বেগুনি রঙে পরিবর্তিত হয় এবং তারপরে এটি কালো হয়ে যায়।
এই কালি আঙুলে লাগালে এতে উপস্থিত সিলভার নাইট্রেট শরীরে উপস্থিত লবণের সঙ্গে মিশে রূপোলি রঙের ক্লোরাইড তৈরি করে। সিলভার ক্লোরাইড ত্বকে লেগে থাকে এবং জল বা অন্য কোন রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলেও তা সহজে উঠে যায় না। এই কালির চিহ্ন তখনই ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায় যখন ত্বকের কোষগুলি পুরানো হয়ে যায় ও ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে।
কালি বিবর্ণ হতে কত দিন সময় লাগে?
২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়, অনেকেই দাবি করেছিলেন যে ভোটের কালি অল্প সময়ের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। এর পরে, নির্বাচন কমিশন একটি বিবৃতি জারি করে বলেছিল যে এই কালি পুরোপুরি উঠতে ১৫ দিন সময় লাগে।