অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, লখনৌ : চৌধুরি চরণ সিং বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে লখনৌ শহরে ঢোকার আগে রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়ল বিজেপির বিশাল বিশাল হোর্ডিং৷ কোনওটায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাট আউট, কোনওটায় হাসিমুখে জোড় হাতে জনতাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন লখনৌ-এর সাংসদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, আবার কোথাও উত্তরপ্রদেশের উন্নয়নকে হাতিয়ার করে ‘অব কি বার, ৪০০ পার’ করার অঙ্গীকার করছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ৷পড়ন্ত বিকেলে নবাবদের স্মৃতি বিজরিত ঐতিহাসিক লখনৌ-র ডাউনটাউন হজরতগঞ্জ চৌরাহাতেই দেখা মিলল বিজেপির জুলুসের সঙ্গে৷ শ’পাঁচেক লোক, দলের পতাকা-প্রতীক, প্রধানমন্ত্রী মোদী ও হ্যাটট্রিক করতে উদ্যত সাংসদ রাজনাথ সিং-র ছবি সহ এলাকা পরিক্রমা করতে শুরু করেছেন বিজেপির নেতা কর্মীরা৷ স্লোগানিং ও পদযাত্রার মধ্যে ভরপুর আত্মবিশ্বাস।
মিছিলের সামনে থাকা স্থানীয় বিজেপি নেতা রাজেশ পান্ডে খোলাখুলিই জানালেন তাঁদের আত্মবিশ্বাসের কারণ৷ তাঁর মতে, ‘মোদীজি তিসরি বার দেশকা প্রধানমন্ত্রী বনেঙ্গে, ইয়ে তয় হ্যায়৷ লখনৌ সে রাজনাথজি ফির সে জিতেঙ্গে, ইয়ে ভি তয় হ্যায়৷ দোনো কা ইসবার হ্যাটট্রিক হোগা৷ আপনি গোটা লখনৌ ঘুরে যাঁকেই প্রশ্ন করবেন, তিনি একই উত্তর দেবেন৷’
কথায় বলে, নির্বাচনে কোনও কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। তবে তা মাথায় রেখেও বলতে হয়, নবাবের শহর থেকে হ্যাটট্রিক করার ক্ষেত্রে কয়েক যোজন এগিয়ে আছেন রাজনাথ৷ সমাজবাদী পার্টির রবিদাস মেহরোত্রা, বসপার সরবর মালিকের পক্ষে রাজনাথের বিজয়রথ থামানো যে রীতিমতো দুষ্কর, তা মেনে নিচ্ছেন বিরোধী শিবিরের নেতারাও৷
এখানেই বিরোধীদের ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে৷ কংগ্রেস ও সপা শিবিরের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেরই অভিমত, লখনৌ আসনে রাজনাথকে হারানোর জন্য যে পরিমাণ হোম ওয়ার্ক করা উচিত ছিল, তার কিছুই হয়নি৷ কংগ্রেসের এক প্রথম সারির নেতার অভিযোগ, ‘প্রিয়াঙ্কা গান্ধী উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বে ছিলেন৷ তারপরেও তিনি লখনৌ নিয়ে আলাদা করে কিছুই ভাবেননি, তাঁর দলও নয়৷ গত ৩০ বছর ধরে এখানে পদ্ম ফোটেই, মনে হয় না এ বারও অন্য কিছু হবে বলে।’
দেশের স্বাধীনতার পরের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেসের বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, সম্পর্কে জওহরলাল নেহরুর বোন। কিন্তু পরবর্তী কালে এই আসন আর ধরে রাখতে পারেনি হাত শিবির, তা চলে যায় জনসঙ্ঘের দখলে। তার পরে বিজেপি। অটলবিহারী বাজপেয়ী এই আসন থেকেই পরপর পাঁচবার জয়ী হয়েছিলেন। অটল ছিলেন লখনৌ-র মুঘল ‘ডিশ’ এবং মিষ্টির মারাত্মক ভক্ত।
তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর জন্য লখনৌ-এর বিখ্যাত ‘দুধিয়া বরফি’ দিল্লিতে নিয়ে যেতেন বিজেপি নেতারা৷ ৯ লিটার দুধ জাল দিয়ে তৈরি হত ১ কেজি বরফি৷ সেই দুধিয়া বরফি আজও পাওয়া যায় লখনৌতে, তবে তার গ্ল্যামারে মরচে ধরেছে। তবে, বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে ‘তুন্ডে কাবাব’, ‘আওধি বিরিয়ানি।’
লখনৌয়ের ঐতিহাসিক ভুল ভুলাইয়া থেকে পাথর ছোড়া দূরত্বে বসে অবধি বিরিয়ানি আর গলৌতি কাবাব দিয়ে ডিনার করতে করতে লখনৌ লোকসভা আসনের পরিসংখ্যানগত বিশেষত্ব বোঝালেন প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমর ত্রিপাঠি৷ তাঁর কথায়, ‘লখনৌ আসনের মধ্যে আছে আলমবাগ, ইন্দিরা নগর, জানকীপুরম, গোমতি নগর, গলফ সিটি, হজরতগঞ্জের মতো পশ এলাকা৷ এখানে বিজেপির রমরমা গত তিন দশক ধরেই৷
২০১১-র জনগণনা বলছে, ২১ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু৷ তাঁদের ভোট পেতে বিরোধীদের যে ভাবে এগোতে হত, সেটা করা হয়নি৷ তাই এখানে অঘটন ঘটানো কার্যত অসম্ভব৷’ একই সুর শোনা গেল হজরতগঞ্জ এলাকার জনপথ মার্কেটের বাঙালি ব্যবসায়ী রণজিত্ দাসের গলায়৷ তিন পুরুষ ধরে লখনৌ চিকনের কারবার করা রণজিতের দাবি, ‘এখানে পরিবর্তন বনাম প্রত্যাবর্তনের কোনও লড়াই নেই, এখানে শুধুই প্রত্যাবর্তন৷’
২০ মে লখনৌ আসনের ভোট গ্রহণ৷ তবে রাজনাথ এখনও প্রচার শুরু করেননি। রাজ্যের প্রভাবশালী বিজেপি নেতা ধরমপাল সিং-র যুক্তি, ‘রাজনাথজি গোটা দেশে প্রচার করছেন, তাঁর অনেক দায়িত্ব৷ এখানে আমরা সব সামলে নেব, উনি যথাসময়ে আসবেন প্রচারে, তাড়াহুড়ো নেই৷’ এই আত্মবিশ্বাসই বিজেপির তুরুপের তাস। লখনৌয়ে। উত্তরপ্রদেশে। দেশেও।