ভোটে ‘তারে জ়মিন পর’, সেলিব্রিটি-ইমেজেই কি মজে ভোটার
এই সময় | ১১ এপ্রিল ২০২৪
জয় সাহা
সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন যাঁরা, ভোটের আগে সেই তারকারাই কারও বাড়ির দাওয়ায় পাত পেড়ে বসে পড়ছেন এক থালা ভাত নিয়ে। কেউ দই খেয়ে মুগ্ধ। তাঁরাও প্রার্থী। কেউ বিজেপির হয়ে লড়ছেন, কেউ তৃণমূলের হয়ে, কেউ বা অন্য পার্টির জন্য। কিন্তু বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএমই এঁদের একমাত্র পরিচয় নয়। কখনও কখনও তাঁদের পরিচিতি দলের ঊর্ধ্বে। তেমনই বহু তারকার ছড়াছড়ি বাংলার ভোট ময়দানে। এমনকী দেশেও তাঁদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এ যেন ভোট-মরশুমে ‘তারে জ়মিন পর’।স্টারডমের জন্যই কি মানুষ এই প্রার্থীদের ভোট দেন? নাকি অন্য কোনও ফ্যাক্টর কাজ করে? এঁদের নিয়ে কী অভিমত ভোটারদের? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফরেন ট্রেড’-এর অধ্যাপক-গবেষকরা। সম্প্রতি একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন তাঁরা। প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিবেক রায়চৌধুরী, দেবাশিস চক্রবর্তী, আর জ্ঞানশঙ্কররা তাঁদের সমীক্ষায় দেখতে চেয়েছেন, সেলিব্রিটি রাজনীতিকরা কি ভোটারের কাছে সব সময়ে শুধুই সেলিব্রিটি?
সমীক্ষার উত্তর বেশ চমকপ্রদ। সৈকত জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ এক কথায় মেনে নিয়েছেন যে তারকা প্রার্থীদের নানা পজ়িটিভ দিক রয়েছে। প্রথমত তাঁরা স্টার, দ্বিতীয়ত তাঁরা মোটের উপর দুর্নীতি-পরায়ণ নন। কিন্তু প্রায় সব বয়সের মানুষ, বিশেষত ইয়ং জেনারেশন মনে করছে, তারকা ক্যান্ডিডেটরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই প্রচার পান। অহেতুক এই গুরুত্বে ভোটাররা বিরক্ত হন বলেই সৈকতের বক্তব্য।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কোনও সেলিব্রিটি ভোটের ময়দানে প্রথম পা রাখলে তাঁকে ভোটাররা তারকা হিসেবেই দেখেন। কিন্তু এঁরাই যখন দ্বিতীয়, তৃতীয় বা আরও বেশিবার মানুষের কাছে ভোট চাইতে যান, তখন কেবল তারকা ইমেজের উপরে ভর করে ভোট বৈতরণী পেরোনো সহজ হয় না। তখন মানুষ সেলিব্রিটিদেরও রাজনীতিবিদ হিসেবেই ধরে নেন। তাঁদের কাজ, পলিটিশিয়ান হিসেবে গতিবিধির সঙ্গে তাঁর দলের যোগ আছে কি না, নিজেদের আখের গোছানোই কি এঁদের লক্ষ্য — এ সব বিচার করেই ভোট দেন মানুষ।
সার্ভেয় আরও জানা গিয়েছে, মহিলা ভোটাররা তবু সেলিব্রিটি ইমেজে মজে থাকেন। পুরুষরা কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ভোট চাইতে আসা তারকাদের আর সে ভাবে দেখেন না। নবীন প্রজন্মের অনেকেই সমীক্ষায় জানিয়েছেন, এই তারকাদের নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হয়। তবে এ কথাও উঠে এসেছে যে, একজন সেলিব্রিটির ইমেজ যদি স্বচ্ছ হয়, তিনি যদি জনপ্রিয় হন, তা হলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ তাঁকে ভোট দিতে পিছপা হন না।
সৈকতের সংযোজন, ‘আরও একটি ট্রেন্ড উঠে আসছে। যা নিয়ে আমরা এখনও অ্যানালিসিস চালাচ্ছি। দেখা যাচ্ছে, কোনও পার্টির বিরুদ্ধে যদি মানুষের ক্ষোভ থাকে, তা হলে কিন্তু সেলেবরা প্রার্থী হলেও দলকে বাঁচাতে পারেন না।’ মূলত পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের উপর এই সমীক্ষা হলেও সারা দেশের তারকা প্রার্থীরাই ছিলের সমীক্ষকদের নজরে।
তৃণমূলের তারকা প্রার্থী শতাব্দী রায় বীরভূমের মানুষের কাছে এই নিয়ে চতুর্থবার ভোট চাইতে যাচ্ছেন। সমীক্ষা সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘আমাকে মানুষ যেমন সেলিব্রিটি হিসেবে দেখেন, তেমনই এমপি হিসেবেও আমার কাজ, আমার রিপোর্ট কার্ড দেখেই ভোট দেন। না হলে পরপর তিনবার জেতাতেন না ভোটাররা।’ সেলিব্রিটিরা যে অতিরিক্ত প্রচার পান, সে কথা মেনে নিয়েও শতাব্দীর সংযোজন, ‘একজন রাজনীতিবিদের ইন্টারভিউ যদি মিডিয়া একবার দেখায়, তা হলে সেলিব্রিটিদের ইন্টারভিউ সেই মিডিয়াই দশবার সম্প্রচার করে। কারণ তারকাদের প্রতি মানুষেরও আগ্রহ আছে। সেই আগ্রহ না থাকলে হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রচার সেলেবরাও পাবেন না।’
হুগলিতে এ বার লড়াই তারকা বনাম তারকার। সেখানে বিজেপির প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় এখন পোড়খাওয়া রাজনীতিক হলেও তাঁর অভিনেত্রী ইমেজও অটুট। তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার লড়াই করছেন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। লকেট অবশ্য বলছেন, ‘সন্দেশখালির মেয়ে এবং বসিরহাটের প্রার্থী রেখা পাত্রকে কেন আমরা সেলিব্রিটি বলব না? কেন কোনও ডাক্তার বা আইপিএস-কে তারকা বলছি না?’
লকেট মনে করেন, সব দলই তথাকথিত সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত ইমেজকে কাজে লাগিয়ে সহজে ভোট জিততে চায়। তাঁর মতে, এই ‘ট্রিক’টা পশ্চিমবঙ্গে শুরু করেছিল তৃণমূল। সেলিব্রিটি ক্যান্ডিডেটদের নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতিতে মানুষের বিরক্তির সঙ্গে সহমত লকেট। তাই তিনি এখন নিজেকে সেলিব্রিটির বদলে একজন সর্বক্ষণের রাজনীতিক হিসেবেই পরিচয় দিতে বেশি স্বচ্ছন্দ।
ভোটের ময়দানে সরাসরি নাম না লেখালেও বামেদের হয়ে প্রচার করতে দেখা যায় অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্রকে। তারকা প্রার্থীদের নিয়ে বিরক্ত তিনি। শ্রীলেখার কথায়, ‘ভোটের জন্য মাটিতে পাত পেড়ে খেলেই মাটির মানুষ হওয়া যায় না। ভোটের ময়দানে যাঁরা সেলিব্রিটি পরিচয় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের বেশিরভাগই অভিনয় করছেন। এঁরা রাজনীতির বানানটাও ঠিক করে বলতে পারেন বলে মনে করি না।’ তাই মানুষের এই ‘সেলিব্রিটি-প্রেম’ দেখে হতাশ শ্রীলেখা।
যদিও শ্রীলেখা যে দলকে সমর্থন করেন বলে দেখা যায়, সেই সিপিএমও নির্বাচনে অভিনেতা দেবদূত ঘোষকে প্রার্থী করেছে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে। আর এ-ই প্রথম নয়। দেবদূতই গত বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হয়েছিলেন টালিগঞ্জ কেন্দ্রে। তা ছাড়া অতীতে অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়দেরও টিকিট দিয়েছিল বাম।