খোলার রং হালকা তামাটে। দেখে দেশি মুরগির ডিম বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওগুলোর সঙ্গেই রাখা সাদা খোলার, মানে পোলট্রি-র সেদ্ধ ডিমগুলো। দেশি ডিম, দাম স্বভাবতই বেশি হবে। কিন্তু কী আশ্চর্য, দু’রকম সেদ্ধ ডিমের দাম-ই ১০ টাকা পিস! আসলে তামাটে রংয়ের খোসার ডিমগুলোও পোলট্রির। তবে হাফ বয়েল্ড। ওগুলো যাতে ফুল বয়েল্ড ডিম থেকে আলাদা করা যায়, সে জন্য সেদ্ধ করার সময়ে জলে অল্প চা পাতা ফেলে আনা হয়েছে অমন রং।বোলপুরের নেতাজি রোডে, ফ্লাইওভার লাগোয়া ‘ঝন্টু রেস্টুরেন্ট’ (আসলে মাথার উপর অস্থায়ী ছাউনি দেওয়া ঝুপড়ি দোকান)-এ রোজ দেড়শো-দু’শো সেদ্ধ ডিম বিক্রি হয়। তা ছাড়া মুরগির কারি, ঘুগনি, আলুর দম, তড়কা, মুরগির ছাঁট আর খাসির ছাঁটের ঝাল-চচ্চড়িরও চাহিদা ব্যাপক। এক সময়ে নিয়মিত মিলত খাসির মেটে কষা।
যেটা ফেভারিট ছিল বীরভূম জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি পদে মাস পাঁচেক আগে কার্যত প্রাক্তন হয়ে যাওয়া, গোরু পাচার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন তিহাড় জেলে বন্দি অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডলের। কালীভক্ত অনুব্রতর ছবি একদা ভাইরাল হয়েছে সমাজ মাধ্যমে। বোলপুরে ডাঙালি কালীমায়ের মন্দিরের উল্টো দিকে বছর চুয়ান্নর ঝন্টু দত্তর ইটারির অবস্থান।
টানা প্রায় চার দশকের কারবার। তার ৫০ মিটারেরও কম দূরত্বে, নিচুপট্টিতে বীরভূম জেলা তৃণমূল কংগ্রেস কার্যালয়। ঢোকার মুখে দেওয়ালে একটা বোর্ড। যাতে স্পষ্ট উল্লেখ যে, বীরভূমে দলের কাজকর্ম এখন যৌথ নেতৃত্বের--- কোর কমিটির হাতে। তবে সেই বোর্ডে কোর কমিটির পাঁচ জন সদস্যের ছবির উপরে অনুব্রত মণ্ডল- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাঝখানে।
‘অনুব্রত যখন অনুব্রত হয়নি, ও যখন শুধুই কেষ্ট, তখন ও আমার কাছে এসে মেটে কষা খেয়ে যেত। সপ্তাহে অন্তত একদিন। খুব ভালোবাসত ওটা খেতে। সে সব কত স্মৃতি। পরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি হওয়ার পর ও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল,’ এগ তড়কা রাঁধতে রাঁধতে বলছিলেন ঝন্টু দত্ত। সেই অনুব্রত গ্রেপ্তার হওয়ার পর খারাপ লাগেনি?
একটা ফুল বয়েল্ড ডিম টেবিলে মেরে খোলা ফাটিয়ে ঝন্টু দত্ত বললেন, ‘এই ডিমটার দাম ১০ টাকা। আপনাকে যদি আমি বলি, এটার ২৫ টাকা দাম, আপনাকে দিতেই হবে, তা হলে আপনি হয়তো দামটা দেবেন, কিন্তু আপনার অভিশাপ আমার উপর পড়বে। অনুব্রতরও তা-ই হয়েছে।’
বোলপুর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের আমোদপুর এলাকার যুবক, পেশায় গাড়ি চালক সুরজিৎ অঙ্কুরও বলছেন, ‘চুরি, চুরি আর চুরি। কত চুরি যে কেষ্ট মোড়ল করেছে, ভাবা যায় না। লুটেপুটে খেয়েছে।’ এখন কখনও গনগনে গরম, কখনও চৈত্র পবনের এই রবিতীর্থ ও তার আশপাশে কান পাতলে ‘পুরাতন ভৃত্য’-তে গিন্নির বলা ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ কথাটার যেন প্রতিধ্বনি। কিন্তু তাতে অনুব্রতর দল কি আসন্ন লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাবে?
বোলপুর স্টেশন থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে, রূপপুর গ্রামের সোনালি লোহার বলছেন, ‘যে যেমন কর্ম করেছে, তাকে তেমন ফল ভোগ করতেই হবে। তবে ও সব দিয়ে আমাদের কী? আমাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা দিদি বাড়িয়ে দিলো। তৃণমূলকে ভোট না-দিলে বেইমানি হবে।’ রূপপুরেরই একটি ঝাঁ চকচকে রিসর্টের কর্মী, স্থানীয় যুবক ইন্দ্রজিৎ দাসের কথায়, ‘খারাপ কিছু করলে কেউ রেহাই পাবে না। সে জন্যই অনুব্রত মণ্ডল জেলে। তবে তৃণমূলের অন্য নেতারা সব সামলে দিচ্ছেন।’
রূপপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের এই রূপপুর গ্রামের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ মুসলমান, ৪০ শতাংশ হিন্দু। রূপপুরের ওই রিসর্টের গা ঘেঁষে থাকা ১৩ বিঘার একটি জমি, স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, তিন-সাড়ে তিন বছর আগে দু’জনের নামে নথিভুক্ত হয়। তবে গ্রামবাসীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, দেড় কোটি টাকার কিছু বেশি দামে ওই জমি আসলে অনুব্রত মণ্ডলই কিনে তাঁর দুই ঘনিষ্ঠর নামে সেটা রেজিস্ট্রি করান--- ওই জমি বেনামে কেনা অনুব্রতর বহু সম্পত্তির একটা।
‘চুরি করেছে বলেই কেষ্ট জেলে গিয়েছে। বেশ হয়েছে। এ রকম লোকের সমাজে না-থাকাটাই ভালো,’ বলছেন রূপপুর গ্রামের কৃষক বক্কর মিয়াঁ। অবসর সময়ে টোটো চালান বক্কর, যে টোটো কেনার এক লাখ টাকা তিনি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে লোন পেয়েছেন। বছর পঁয়ত্রিশের বক্কর কিন্তু কেষ্টর দলকে দোষারোপ করতে নারাজ।
তাঁর ব্যাখ্যা, ‘শোনেননি, দিদি কী বলেছেন? এক জন মানুষ খারাপ বলে কি বাকি হাজারটা মানুষও খারাপ? আর আমাদের মতো গরিবদের কত ফেসিলিটি দিদি দিচ্ছেন, সেটা ভাবুন। বাড়ি দিচ্ছেন, বিনা পয়সায় চাল-গম-আটা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা বাড়িয়ে দিলেন। দিদিকে ভোট দেওয়া মানে গরিব মানুষের অনেক সুবিধে। কেষ্ট মণ্ডল নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।’
তবে কেষ্টর সিমপ্যাথাইজ়ারও যে একেবারেই নেই, তা নয়। ইলামবাজারের বাতিকর গ্রাম পঞ্চায়েতের মাকড়া গ্রামের মিনহাজুল মোল্লা, মহম্মদ রাজেশ রওশনরা যেমন। ওঁরা সোনাঝুরি হাটে শাড়ির পশরা নিয়ে বসেন। একটা সময়ে সোনাঝুরি থেকে গোটা হাট সরানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। উচ্ছেদের সেই উদ্যোগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন শাসক দলের তদানীন্তন জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল।
মাধ্যমিক পাশ, ২৩ বছরের মিনহাজুল বলছেন, ‘অনুব্রত মণ্ডল জেলে আছেন বলে আমাদের খারাপ লাগে। উনি না-থাকলে সোনাঝুরিতে আমাদের কারবারই বন্ধ হয়ে যেত।’ ভোটের এই বাজারে কেষ্ট মণ্ডল তাই না-থেকেও থাকছেন। তা সে পজ়িটিভ-ই হোক, কিংবা নেগেটিভ- দু’অর্থেই। রবিতীর্থের রাজনীতি যেন কবিগুরু রচিত ‘বোঝাপড়া’, যেখানে ‘তোমায় কতক ফাঁকি দেবে তুমিও কতক দেবে ফাঁকি, তোমার ভোগে কতক পড়বে পরের ভোগে থাকবে বাকি…।’