• উলটো করে ঝোলানোর নিদানে প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই
    এই সময় | ১১ এপ্রিল ২০২৪
  • মণিপুস্পক সেনগুপ্ত

    এই সময়: উল্টো করে ঝুলিয়ে অপরাধীদের সাজা দেওয়ার কথা মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস বই ঘাঁটলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০২৪-এর ভারতে কোনও ভয়ঙ্কর অপরাধীকেও কি এভাবে শাস্তি দেওয়া যায়? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবশ্য চাইছেন, পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে বোমা বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের এনআইএ এভাবেই শাস্তি দিক।বুধবার বালুরঘাটে লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে ভূপতিনগরের প্রসঙ্গ টেনে শাহ বলেন, ‘বাংলার মানুষ চিন্তা করবেন না। হাইকোর্ট এনআইএ-কে ভূপতিনগরের তদন্তভার দিয়েছে। সব কো উল্টা লটকাগে সিধা কর দিয়া যায়েগা (সবাইকে উল্টো ঝুলিয়ে সোজা করে দেওয়া হবে)।’ এবারের লোকসভা ভোটে বাংলায় প্রথমবার প্রচারে এসে শাহের এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তপ্ত রাজ্য রাজনীতি।

    কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কীভাবে বিচারাধীন একটি মামলায় শাস্তির নিদান দিয়ে দিলেন, সেই প্রশ্ন তুলে বিজেপিকে আক্রমণ শানিয়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। এমনিতে ইডি-সিবিআই-এনআইএর মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি বিজেপির অঙ্গুলিহেলনেই চলছে—এই অভিযোগ তুলে সরব তৃণমূল-সহ অন্য বিরোধী দলগুলি। সেই প্রেক্ষাপটে শাহের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে জোড়াফুল নেতৃত্বের প্রশ্ন, উনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে কি এনআইএ কী ভাবে ভূপতিনগরের তদন্ত করবে, সেটা দলীয় সভা থেকে ঠিক করে দিতে পারেন?

    ২০২২-এর ডিসেম্বরে পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২৩-এর গোড়ায় কলকাতা হাইকোর্ট এনআইএ-কে সেই বিস্ফোরণের তদন্ত করতে বলে। গত শনিবার ভূপতিনগরে দুই অভিযুক্তকে তুলে আনতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন এনআইএ আধিকারিকরা। তাঁদের গাড়ির কাচ ভাঙা হয়। জখমও হন বেশ কয়েকজন তদন্তকারী অফিসার।

    বাংলার ভোট-রাজনীতি সরগরম এই ইস্যুতে। শাহের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে ভূপতিনগর প্রসঙ্গে তৃণমূলকে বিঁধে গিয়েছেন। এদিন বালুরঘাটে ভোট প্রচারে গিয়ে শাহ বলেন, ‘ভূপতিনগরে বিস্ফোরণ হয়েছিল। তাতে তিনজন মারা গিয়েছিল। আপনারাই বলুন, যারা বোমা ফাটিয়েছিল, তাদের জেলে পাঠানো উচিত, কি উচিত না?’

    তাঁর সংযোজন, ‘ভূপতিনগরের তদন্ত হাইকোর্ট এনআইএ-কে করতে দিয়েছিল। মমতা দিদি এনআইএ-র বিরুদ্ধে মামলা করে তদন্তে বাধা দিচ্ছেন! বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এর জন্য লজ্জা পাওয়া উচিত।’ তৃণমূল সুপ্রিমোর উদ্দেশে শাহের প্রশ্ন, ‘এনআইএ-র বিরুদ্ধে মামলা করে আপনি অপরাধীদের বাঁচাতে চান?’ এরপরই তিনি ভূপতিনগর বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের ‘উল্টো ঝুলিয়ে সোজা করে দেওয়া’র কথা বলেন।

    বালুরঘাটে শাহের সভা শেষ হতেই আসরে নামে তৃণমূল। সাংবাদিক বৈঠক করে তারা এই ইস্যুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘অমিত শাহ প্রকাশ্য জনসভা থেকে আইন হাতে নেওয়ার কথা বলছেন! দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এভাবে কথা বলতে পারেন না। এর থেকেই বিজেপির মানসিকতা বোঝা যাচ্ছে, ওরা এইরকম শাস্তি পদ্ধতি কায়েম করতে চায়। আমরা এ ধরনের কথা বলি না। আমরা আইনের মধ্যে থেকেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে যা পদক্ষেপ নেওয়ার তা-ই নিই।’

    চন্দ্রিমার সংযোজন, ‘কোনও অন্যায় করে থাকলে অবশ্যই শাস্তি হোক। আমরাও সেটা চাই। কিন্তু বিজেপি নেতারা যে ভাষায় কথা বলছেন, তা বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়।’ তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের কটাক্ষ, ‘উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়ার মানে কী? যাদের আপনারা দুর্নীতিগ্রস্ত বলতেন এক সময়ে, এখন তাদের কোলে নিয়ে ঘুরছেন! উল্টো ঝুলিয়ে দেওয়া বলতে কি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন শাহ?’

    সরাসরি এ প্রসঙ্গে না হলেও শাহকে এদিন নিশানা করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, ‘দুর্নীতি নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বালুরঘাটে এসে বলে গিয়েছেন উনি। বিজেপি যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল, ওয়াশিং মেশিনে সাফ হয়ে তারা সবাই বিজেপিতেই আছে।’

    তবে ভূপতিনগরের অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি রয়েছে বঙ্গ-বিজেপিতেও। শাহের এদিনের ভাষণের বিভিন্ন অংশ রাজ্য বিজেপির তরফে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হলেও ‘সব কো উল্টা লটকাগে সিধা কর দিয়া যায়েগা’ মন্তব্যটিকে প্রচারে আনছে না তারা। তবে রাজ্য বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তৃণমূল তো এই ভাষাই বোঝে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর কোমরে দড়ি পরিয়ে ঘোরাবেন। তখন তৃণমূলের ভাষাজ্ঞান কোথায় ছিল? অমিত শাহ সর্বভারতীয় সভাপতি থাকাকালীন বাংলায় ৫৫ জন বিজেপি কর্মী খুন হয়েছেন। এরপর কোন ভাষায় কথা বলবেন উনি?’

    মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের তরফে রঞ্জিত শূরের বক্তব্য, ‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে আমরা শুনলাম মধ্যযুগীয় শাস্তির নিদান! আমরা এর বিরুদ্ধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানাব।’ এই ভূপতিনগর ইস্যুতেই এনআইএ ও বিজেপির সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছে তৃণমূল।

    কেন্দ্রীয় এই এজেন্সির এসপি ধনরাম সিংয়ের সঙ্গে বিজেপি নেতা জিতেন তিওয়ারির বৈঠকের অভিযোগ তুলে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছে তারা। দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানাতে গিয়ে তৃণমূলের প্রতিনিধি দলকে পুলিশ টেনে-হিঁচড়ে সরিয়ে দেয়। এই ইস্যুতে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছেও নালিশ জানিয়েছে তৃণমূল।

    এদিনও রাজভবনে বৈঠক শেষে বেরিয়ে অভিষেক বলেন, ‘আমরা তো ধনরাম সিংয়ের বিষয়টি নিয়ে বলেছি। কিন্তু কী হলো? আমাদের তো নোটিস পাঠানোর কথা বলেছিল (জিতেন তিওয়ারি)। তিন দিন পেরিয়ে গেল, নোটিস তো আসেনি। আমরা আবার বলছি, এই ফুটেজ আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে জমা দেবো।’
  • Link to this news (এই সময়)