‘স্মৃতি’ সততই সুখের মধ্যে ‘রাজপুত কাঁটা’, রবার্টকে হাত ধরতে দেবে কি কংগ্রেস
এই সময় | ১২ এপ্রিল ২০২৪
অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, আমেঠি
একদিক দিয়ে চলে গেছে ৩৪ নম্বর রাজ্য সড়ক, উল্টো দিকে ১২৮ নম্বর জাতীয় সড়ক৷ দুই-এর সংযোগ স্থলে গৌরীগঞ্জ৷ উত্তরপ্রদেশের বহু চর্চিত আমেঠি লোকসভা আসনের প্রাণকেন্দ্র এই তহসিল৷ বসন্তের শেষ লগ্নে সেই গৌরীগঞ্জে ভর দুপুরে দাঁড়িয়ে আতস কাচ নিয়ে কংগ্রেস সমর্থক খুঁজতে হলো৷ কে বলবে প্রায় চার দশক এই আসনটিই ছিল কংগ্রেস বিশেষত গান্ধী পরিবারের আঁতুড় ঘর৷প্রথমে সঞ্জয় গান্ধী, পরে রাজীব গান্ধী, তারপর সনিয়া গান্ধী এবং শেষে রাহুল গান্ধী — ওই পরিবারের চার জন ধারক ও বাহকের ঐতিহ্য সম্পন্ন এই আমেঠিতে এখনও প্রার্থী দিতে পারেনি কংগ্রেস৷ যদিও সনিয়া গান্ধীর জামাই রবার্ট ভাদরা সেখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন। তবে, হাইকম্যান্ড সেই ‘ইচ্ছা’ পূরণ করবেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
দলীয় সূত্রে খবর, রবার্টকে দাঁড় করানোটা বিরাট রিস্ক হবে কি না তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। তবে কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতা বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, গান্ধী-নেহরু পরিবারেরই কেউ দাঁড়াবেন। তাই বিরোধী শিবিরের এই ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে আপাতত অ্যাডভান্টেজ বিজেপি নেত্রী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। তবে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে বিজেপি।
২০১৯ সালে ৫০,০০০-র বেশি ভোটে জয়ী হওয়া স্মৃতি এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছেন গত পাঁচ বছরে যে এখান থেকে গান্ধী পরিবারের নাম ও নিশান প্রায় মিটতে বসেছে, দাবি আমেঠির বিজেপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের৷ ‘পত্রকার’ পরিচয় পেয়ে নিজেই আলাপ করতে আসা ব্যবসায়ী বনোয়ারি লাল কোনও সুযোগ না দিয়ে নিজেই প্রথম প্রশ্ন করে বসলেন, ‘স্যরজি, ইস বার কংগ্রেস কা উম্মিদবার কওন হোগা?’
উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন, ‘আগর রবার্ট ভাদরা লড়নে আয়ে তো, স্মৃতিজি কেয়া জিত পায়েগি?’ প্রশ্ন শুনে রীতিমতো উত্তেজিত বনোয়ারি লাল ও তাঁর সঙ্গীরা৷ সমবেত কণ্ঠে জবাব, ‘লিখ লিজিয়ে, ২ লাখ সে জ়াদা ভোট সে জিত জায়েগি স্মৃতি ম্যাম৷’ গৌরীগঞ্জের বাইরে আমেঠি আসনের বিভিন্ন এলাকা যেমন সুলতানপুর, রায়পুর, রামনগর, সালোন, মুসাফিরখানা এবং তিলোই ঘুরে কোথাও কংগ্রেসের কোনও প্রভাব দেখা গেল না৷ আমেঠিতে লোকসভা কেন্দ্রে গ্রামের সংখ্যা ৯৮৭।
তাই কেন্দ্রের রসায়ন বুঝতে পারবেন এমন প্রার্থীই নাকি খুঁজে বের করতে পারছে না কংগ্রেস, এমনই দাবি অনেকের৷ আনাচে-কানাচে অভিযোগ, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ছাড়া গত পাঁচ বছরে এখানে তেমন ভাবে দেখাই যায়নি রাহুল-প্রিয়াঙ্কাদের৷ এই সুযোগে পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত করে ফেলছেন বর্তমান সাংসদ ও কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি৷
গত পাঁচ বছরে তিনি অন্তত ৫০ বার আমেঠিতে এসেছেন বলে দাবি করছেন বিজেপি নেতা-কর্মীরা৷ এমনই এক স্থানীয় বিজেপি নেতা হরিপ্রসাদ শর্মার কথায়, ‘স্মৃতি ম্যাম হমারে পরিবার কা হিস্সা বন গয়ি হ্যায়৷’ ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে রাহুল গান্ধীকে ৫৫,০০০ ভোটে হারানোর পরে স্মৃতি আমেঠির মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন, এখানকার স্থানীয় মানুষের আপদে বিপদে পাশে থেকেছেন৷
তাঁর এই পদক্ষেপই এ বারের ভোটেও ফারাক গড়ে দেবে বলে আশা বিজেপি সমর্থকদের৷ তাই রবার্ট হোক বা রাহুল বা ‘বিক্ষুব্ধ’ বরুণ গান্ধী — প্রার্থী যিনিই হোন না কেন, স্মৃতির দয় নিয়ে সংশয় নিয়ে কারও। তবে রাজপুত সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে বেশ কিছুটা ক্ষোভ রয়েছে। বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পুরুষোত্তম রুপালা ভোট প্রচারে গিয়ে বলেছেন রাজপুত সমাজ নাকি ‘ঘাটিয়া’ বা মন্দ৷ এই বিতর্কিত মন্তব্যে গোটা উত্তরপ্রদেশের রাজপুত সমাজ চটেছে প্রবল৷
গেরুয়া শিবিরের চিন্তা বাড়িয়ে রাজপুত নেতা পবন সিং ঠাকুর বলেন, ‘রাজপুত সমাজের এই অপমান আমরা সইব না৷ কী করব, সেটা সময় এলেই দেখতে পাবেন৷’ আপাতত স্মৃতি ইরানির বিপক্ষে যেতে পারে এই একটা ফ্যাক্টরই, দাবি বিজেপি সূত্রেই৷ এ দিকে রবার্টের বক্তব্য, ‘আমেঠিতে পা দিতেই ওখানকার মানুষ আমাকে স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন, কিছুই করেননি তিনি ওখানকার জন্য।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আমাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে সংসদে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করেছেন৷ এর পরে আমারও উচিত নিজেকে প্রমাণ করে ওঁর অভিযোগের জবাব দেওয়া৷’ তবে, ভাদরাকে যদি স্মৃতি হারিয়ে দেন, তা হলে বিজেপি সরাসরি গান্ধী পরিবারের ব্যর্থতার নজির তুলে কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ করবে, এটা সহজেই বুঝতে পারছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব৷
ফলে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না তাঁরা, এমনটাই বলছে দলীয় সূত্র। এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে গেরুয়া শিবির কোনও মন্তব্য করেনি৷ কিন্তু রবার্ট কেন আমেঠি থেকে দাঁড়াতে চাইছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘গান্ধী পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকা কার্যত অসম্ভব৷
সবাই চাইছেন, আমি সক্রিয় রাজনীতিতে আসি, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সেবা করি৷’ তবে রাহুল বা প্রিয়াঙ্কা প্রার্থী হলে তিনি তাঁদের লড়াইকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করবেন বলেও জানান৷ আমেঠি আপাতত ‘স্মৃতি’-ময়। তবে সেই স্মৃতি ‘সুখের’ না কি অন্য কিছু তার জন্য অপেক্ষা ৪ জুন পর্যন্ত।