• Fountain Pen: নতুন করে শব্দের ফাউন্টেন ফিরুক কলমে, আশায় ওঁরা
    এই সময় | ১৩ এপ্রিল ২০২৪
  • জয় সাহা ■ কলকাতা

    ও রণবীর দেব অধিকারী

    ■ রায়গঞ্জতরোয়ালের থেকে একটি কলমের জোর অনেক বেশি! এই আপ্তবাক্য শুনতে শুনতে এমন একটি প্রজন্মের সামনে সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সমরাস্ত্র হিসেবে তরোয়ালের দিন গিয়েছে। আর মোবাইল-ল্যাপটপে টাইপিংয়ের স্রোতে কলমের ব্যবহারও ক্রমশ কমে আসছে। পরীক্ষা আর ক্লাসওয়ার্কের বাইরে ছাত্রছাত্রীরাও আর বিশেষ কলম ব্যবহার করছেন না।

    অফিস-কাছারিগুলিও পুরোটাই প্রায় কম্পিউটার বা মোবাইল নির্ভর। রিলস আর ওটিটির যুগে পড়াশোনার পাশাপাশি হাতে লেখার অভ্যাসও কমে আসছে। কালি-কলম ব্যবহার করে দিনলিপি, ডায়েরি লেখা, নিদেনপক্ষে ফর্দ লেখার অভ্যাসও হারাচ্ছে।

    এই অবস্থায় কালি-কলম বা ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার বাড়ানো এবং লেখার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী একদল নাগরিক। রায়গঞ্জ শহরের তরুণ শিক্ষক কৌস্তভ পাল যেমন ছোটবেলা থেকেই নিজের ব্যবহৃত বিভিন্ন ফাউন্টেন পেন বাড়িতে রেখে দিতেন। ২০০৮ সাল থেকে এই শখ তাঁর নেশায় পরিণত হয়। একে একে দেশি, বিদেশি নামীদামি কোম্পানির এত পেন সংগ্রহ করেছেন যে, এখন তাঁর পড়াশোনার ছোট্ট ঘরটাই হয়ে উঠেছে ভিন্টেজ ফাউন্টেন পেনের আস্ত একটি মিউজ়িয়াম। সেখানে ২৫ টাকা থেকে শুরু করে ২৫ হাজার টাকা দামেরও পেন রয়েছে।

    কৌস্তভের পেন মিউজ়িয়ামে একবার ঢুঁ মারলে জানতে পারবেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের শান্তিচুক্তি লেখা হয়েছিল কোন কলম দিয়ে, অথবা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন পেন ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। এমনকী স্বাধীন ভারতের সংবিধানের খসড়া লেখা হয়েছিল যে উইলসন ফাউন্টেন পেন দিয়ে— তাও আছে কৌস্তভের সংগ্রহে। এই সংগ্রহশালার মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন খণ্ডিত ইতিহাসকে মানুষের সামনে তুলে ধরছেন, তেমনই লেখার অভ্যাস যাতে ফিরে আসে, তার সচেতনতা তৈরি করতে চান কৌস্তভ।

    তবে কৌস্তভের মতো এই উদ্যোগে সামিল আরও অনেকেই। ২০ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর ২০২০ সালে বাজারে ফিরে এসেছে সুলেখা কালি। সঙ্গে নানা ধরনের ফাউন্টেন পেন। ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার বাড়াতে সুলেখা ওয়ার্ক লিমিটেড নানা ভাবে উদ্যোগীও হয়েছে। যেমন বিভিন্ন স্কুলে তৈরি করা হচ্ছে ‘কলম-ক্লাব’। সেই ক্লাবে ছাত্রছাত্রীরা হাতের লেখার প্রতিযোগিতা, চিঠি লেখার কম্পিটিশনের আয়োজন করছে। এছাড়াও বিভিন্ন কর্পোরেটের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে, যাতে দীপাবলি হোক অথবা নিউ ইয়ার— কর্পোরেট গিফটে থাকে কালি ও কলমের ব্যবহার।

    সুলেখার কর্ণধার কৌশিক মৈত্রর কথায়, ‘২০ বছরের বিরতির পর যখন আমরা ফিরে এলাম, দেখলাম বাজারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে, বিভিন্ন বইমেলায় স্টল দিয়ে, স্কুলে স্কুলে ক্লাব তৈরি করে কালি-কলমের বিক্রি গত এক বছরে অন্তত ৪০ শতাংশ আমরা বাড়াতে পেরেছি।’

    এখন এই কালির খোঁজে আসছেন অনেকেই। এমনকী ভিন্‌রাজ্য থেকেও অনেকে এসে এই কালি সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। এই কালি ও কলম ব্যবহার করে আঁকা হচ্ছে ছবি, তৈরি হচ্ছে ক্যালেন্ডারও। হাওড়া শিবপুরের শ্রীমৎ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়ে যেমন কলম-ক্লাব রয়েছে। সেখানকার প্রধান শিক্ষক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘শুধু ক্লাব করেই আমরা থেমে নেই। স্কুলে ডিয়ার হেডমাস্টার বলে একটি প্রতিযোগিতাও আমরা শুরু করেছি। যেখানে ছেলেমেয়েরা হাতে লেখা চিঠি দিচ্ছে প্রধানশিক্ষককে। সেরা হাতের লেখা ও চিঠিকে আমরা পুরস্কৃত করছি।’

    গত ৩০ বছর ধরে কলম সংগ্রহ ও লেখালেখির অভ্যাস বাড়ানোর জন্য অক্লান্ত লড়ছেন কলকাতার পদ্মপুকুরের বাসিন্দা শুভব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। প্রবীণ এই মানুষটির বাড়িতেও রয়েছে বহু ধরনের কলমের সংগ্রহ। শুভব্রত শোনাচ্ছেন, কীভাবে গত কয়েক বছরে এই কলমের ব্যবহার বাড়াতে বহু নাগরিক এগিয়ে এসেছেন। শুভব্রতর দাবি, ইন্টারনেট-কম্পিউটার যেমন কালি-কলমের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে, তেমনই আবার সেই ইন্টারনেটেই বাড়ির ধুলোয় পড়ে থাকা দাদু-ঠাকুর্দার কলম চড়া দামে অনেকে কিনছেন।

    কোভিডের ঘরবন্দি সময়ে কম্পিউটার-মোবাইলের নেশা ছাড়াতে অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের কলম ব্যবহারে উৎসাহ দিয়েছেন। কোভিডপর্ব কেটে যাওয়ার পরেও সেই উৎসাহে ভাটা পড়েনি। শুভব্রতর কথায়, ‘ইদানিং বেশ কিছু চিকিৎসকও আঙুলের বাতের চিকিৎসার জন্য রোগীকে দিনে অন্তত দু’পাতা করে লেখার পরামর্শ দিচ্ছেন। যাতে মন-শরীর-আঙুল সচল থাকে। সেই রোগীরাও গত কয়েক বছরে কলম কিনতে চেয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন।’
  • Link to this news (এই সময়)