নতুন বাংলা বছর এসে গেল। তার সাথেই এসে গেল সেই সময় যখন সমাজমাধ্যম জুড়ে চলবে উত্তপ্ত বিতণ্ডা -- বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা কে। এক পক্ষ খাড়া করবে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ -- কুণাল চক্রবর্তী ও শুভ্রা চক্রবর্তী, অমর্ত্য সেন, বা শোয়েব দানিয়েলের লেখা। আবুল ফজলের বয়ান থেকে মেলে ষোড়শ শতকের শেষে আকবরের চালু করা 'তারিখ-ই-ইলাহি' অব্দের কথা।প্রচলিত হিজরি অব্দের চান্দ্রমাসের হিসাব বদলে দিয়ে ভারতে প্রচলিত বিভিন্ন ক্যালেন্ডারের সৌরমাসের হিসাব সংযুক্ত করেন আকবর-নিযুক্ত জ্যোতির্বিদ ফাতুল্লা শিরাজি। সূচনাবিন্দু ধরা হয় আকবরের রাজ্যাভিষেকের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরিকে। কালক্রমে হিজরি ক্যালেন্ডারের মাসের নামগুলির জায়গা নেয় ভারতে প্রচলিত নানা ক্যালেন্ডার (বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, গুপ্তাব্দ)-এর মাসের নামগুলি।
অমর্ত্য সেনের কথায়, আকবরের সমন্বয়ী ভাবনারই একটি প্রতিফলন এই ক্যালেন্ডার। তারিখ-ই-ইলাহির উত্তরাধিকার রয়ে গেছে এ দেশের নানা ক্যালেন্ডারে। বাংলা সনের হিসাবেও কী তাই? দানিয়েল দেখিয়েছেন আকবরের সিংহাসনারোহণের হিজরি অব্দ (৯৬৩)-র সাথে খ্রিস্টাব্দের হিসাব (বর্তমান খ্রিস্টাব্দ - আকবরের সিংহাসনারোহণের সাল অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ) যোগ করলেই মিলে যায় বর্তমান বাংলা সনের হিসাব। যেমন এবার শুরু হবে ৯৬৩+(২০২৪-১৫৫৬) = ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। তবে ফসলের মরসুমের কথা খেয়াল রেখে চৈত্রের বদলে নববর্ষ সূচিত হয় বৈশাখে।
খাজনা আদায়ের সুবিধাই যে এই ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, তার প্রমাণ মেলে পড়েও। মুর্শিদকুলি খাঁ-র সময় থেকে বাংলার প্রায়-স্বাধীন নবাবরা নববর্ষের উৎসব করতেন এই দিনে, 'পুণ্যাহ' নামে, যা ছিল খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠানও। আকবরের এই ক্যালেন্ডার কী শিরাজিরই উদ্বাবন, নাকি বৈশাখ থেকে শুরু হওয়া স্থানীয় কোনও ক্যালেন্ডারকেই গ্রহণ করেছিলেন শিরাজি? কেউ কেউ মনে করেন হুসেন শাহি আমলে তেমন কোনও ব্যবস্থা থেকে থাকতে পারে। নীতীশ সেনগুপ্ত তারও আগের দুটি মন্দিরে বঙ্গাব্দের উল্লেখের কথা বললেও তেমন কোনও মন্দিরের খতিয়ান নেই ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বক্ষণের প্রকাশিত রিপোর্ট বা আবিষ্কৃত লেখমালায়।
তবুও সমাজমাধ্যমে বা জনপ্রিয় সিনেমায় শোনা যায় বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে শশাঙ্কের নাম। এই তথ্য শুনলে শশাঙ্ক অবাক হতেন বই কী! কারণ তাঁর লেখ বা মুদ্রায় বঙ্গাব্দের ব্যবহার হয়নি, শশাঙ্কপরবর্তী পাল-সেন শাসকদের নথিতেও কোথাও নেই বঙ্গাব্দের ধারণা। বরং শশাঙ্কের অধীনস্থ মাধববর্মার গঞ্জাম লেখ থেকে স্পষ্ট যে শশাঙ্কের রাজত্বে ব্যবহৃত হত গুপ্তাব্দ। তবে পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব তো শুধু ক্যালেন্ডারের কচকচিতে নয়।
বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীরা এই দিনেই করেন তাঁদের হালখাতার গণেশ-আরাধনা -- গণেশ চতুর্থীর উৎসব ক্রমশ বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকে যা ছিল বাঙালির গণেশপুজো। ২৫ শে বৈশাখের তীব্র দাবদাহে শান্তিনিকেতন ছাত্রছাত্রীদের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠত বলে পয়লা বৈশাখেই কবির জন্মদিন উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কবি স্বয়ং। সে কথা ১৯৩৬-এর। কিন্তু তারও অনেক আগে, ১৮৯১ সালে, পুণ্যাহ-র অনুষ্ঠানে হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের এবং জমিদারের আলাদা আলাদা তিনরকম আসনে বসার প্রথা তুলে দিয়ে একাসনে সবার বসার রীতি চালু করেছিলেন পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের তরুণ জমিদার রবীন্দ্রনাথ।
আবার বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিদের অন্যতম প্রধান উৎসব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ আয়োজিত পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা পেয়েছে ইউনেস্কোর ইন্ট্যাঞ্জিবল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর স্বীকৃতি। সে দেশের মৌলবাদীদেরও যদিও চক্ষুশূল হয়েছে এই অনুষ্ঠান। যে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় সদ্যপ্রকাশিত কিউ এস আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং-এ তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় সফলতম ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে উঠে এসে, সেখানেও বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের চিরাচরিত বৃহত্তম উদযাপন ছিল (সম্ভবত এখনও আছে) বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান।
সে অনুষ্ঠানে দিল্লিপ্রবাসী ছাত্রছাত্রীরা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক, অভিনীত হয়েছে চিরকুমার সভা, শেষরক্ষা, বকবধপালা, লঙ্কাদহনপালা, সলিউশন এক্স, মহাবিদ্যা-র ম'ত নাটক। বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যেও পয়লা বৈশাখ তাই আপামর বাঙালির এক অনন্য উৎসব -- যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ, সুলতানি-মোগল শাসন ও রবীন্দ্র-ঐতিহ্য, কৃষক ও ব্যবসায়ী, বঙ্গবাসী ও প্রবাসী, সরকারি রাজস্ব আদায়কারী থেকে মুক্তমনা ছাত্রছাত্রী। সমস্ত বাঙালির অংশিদারিত্বের এরকম উৎসব আর কটি?