ভয়াবহ জলসঙ্কট আসন্ন? পাহাড় কেটে বেরিয়ে আসা ঝরনাগুলো কি আর কয়েক বছরের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে? পূর্ব হিমালয়ের বরফে ঢাকা চূড়াগুলোর সব বরফ গলে কি নেড়া পাথর বেরিয়ে পড়বে? ২০২৪-এ উত্তর সিকিমে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকরা সেখানকার যা প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেছেন, তাতে দূর দূর পর্যন্ত তাঁদের এমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু বাংলার চার ভূগোল গবেষকের সাম্প্রতিকতম গবেষণার যে রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে এলসেভিয়ার বিজ্ঞান পত্রিকায়, সেটা ভয় ধরানোর পক্ষে যথেষ্ট।উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর পর পৃথিবীর এই এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি বরফের সঞ্চয়। এই কারণেই তিব্বতের মালভূমি এবং তাকে বিভিন্ন দিক থেকে ঘিরে রাখা হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশ, কুনলুন এবং তিয়েনশান পর্বতে ঘেরা বিস্তীর্ণ অঞ্চলটিকে কোনও কোনও ভূতত্ত্ববিদ উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর পর ‘থার্ড পোল’ বা তৃতীয় মেরু বলে ডেকে থাকেন।
আবার বিপুল পরিমাণে মিষ্টি জল জমা বরফের ভাণ্ডারের জন্য কোনও ভূতত্ত্ববিদ এই অঞ্চলকে ‘এশিয়ান ওয়াটার টাওয়ার’ বলেও উল্লেখ করেন। এমন নামকরণ অমূলক নয়। বিস্তীর্ণ এই অঞ্চল অন্তত ৯৫ হাজার ৫০০ হিমবাহের উৎসস্থল। এর মধ্যে শুধু হিমালয় থেকেই ২০ হাজারের বেশি হিমবাহ তৈরি হয়েছে। ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, চিন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এবং তাজিকিস্তানের মতো দেশের পানীয় জলের জোগান আসে ওই হিমবাহগুলো থেকেই।
ভয়াবহ জলসঙ্কট আসন্ন
কিন্তু ওই হিমবাহগুলোর মেয়াদ কতদিন? আট দেশের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ পানীয় জলের জন্য ওই হিমবাহগুলোর ওপরেই প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভরশীল। কারণ এই অঞ্চলের হিমবাহগুলো থেকেই তৈরি হয়েছে গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, আমু দরিয়া, সির দরিয়া, মেকং, ইরাওয়াড্ডির মতো বিরাট নদীগুলো। সিকিমের কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের প্রধান চারটি হিমবাহ জেমু, তালুং, আলুকথাং এবং রাথোংয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা চালিয়েছিলেন রাজ্যের পাঁচ গবেষক।
এঁরা হলেন সুধু-কানু-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বজিৎ বেরা ও সৌমিক সাহা, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজের সুমনা ভট্টাচার্য, ডায়মন্ড হারবার উইমেন্স ইউনিভার্সিটির নৈঋতা সেনগুপ্ত এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃদুল বর্মণ। বাংলার পাঁচ গবেষকের পর্যবেক্ষণের ফল প্রকাশ হয়েছে বিজ্ঞান-বিষয়ক পত্রিকা এলসেভিয়ারে। সেই ফল রীতিমতো উদ্বেগজনক।
তাঁদের গবেষণা সম্পর্কে বিশ্বজিৎ বেরা বলেন, ‘আমরা প্রধানত কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কে কাজটা করেছিলাম। ওই অঞ্চলে ১৮টি হিমবাহ রয়েছে। আমরা ১৯৯০ থেকে ২০২২ — ৩২ বছরের উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ করেছি।’ গবেষক বলছেন, ‘ওই পার্কের সবচেয়ে বড় হিমবাহ হলো জেমু। এর জলেই পুষ্ট তিস্তার মতো নদী। আমরা দেখেছি তিন দশকে জেমু হিমবাহের দৈর্ঘ্য ৭৫০ মিটার কমে গিয়েছে। শুধু জেমু নয়, বাকি সব ক’টি হিমবাহই সঙ্কুচিত হয়েছে। এই লক্ষণ ভালো নয়।’
গবেষকরা জানাচ্ছেন, হিমবাহ সঙ্কুচিত হতে থাকলে তার গতিপথ বরাবর ছোট-বড় নানা রকমের হ্রদ তৈরি হয়। এদের গ্লেসিয়াল লেক বলে। এই ধরনের হ্রদে জল জমে থাকে। হিমবাহ বেশি করে গলতে থাকলে গ্লেসিয়াল লেক উপচে যাওয়ার বা তাদের পাড় ভেঙে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা খুব বেশি থাকে।